সংক্রমণ ৬৪ জেলায়

2-samakal-5eb30a6476377

শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে পড়ল। এতদিন ধরে প্রতিরোধ লড়াইয়ে টিকে থাকা রাঙামাটিতেও শেষ পর্যন্ত মিলেছে করোনার অস্তিত্ব। গতকাল বুধবার দেশের এই পার্বত্য জেলায় চারজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এখন দেশের ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস।

নমুনা পরীক্ষার পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যদিও গত কয়েকদিনে মৃত্যুর সংখ্যা কম। বিপরীতে সুস্থতার হারও বাড়ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় আরও ৭৯০ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭১৯ জনে। চব্বিশ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে আরও তিনজনের। মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৮৬।

এদিকে সারাদেশে করোনার বিস্তার ঘটার প্রেক্ষাপটেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গতকাল সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী কিছু নির্দেশনাসহ একটি ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১৬ এপ্রিল যে নির্দেশনাটি দেওয়া হয়েছিল, তাতে কিছুটা পরিবর্তন এনে গতকাল দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রশমনে জনগণকে অবশ্যই ঘরে অবস্থান করতে হবে। সন্ধ্যা ৬টার পরিবর্তে রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন (প্রয়োজনীয় ক্রয়, বিক্রয়, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধ ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ সৎকার ইত্যাদি) ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। এক জেলা থেকে অন্য জেলা এবং এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় জনসাধারণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। জেলা প্রশাসন অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ নিয়ন্ত্রণ সতর্কভাবে বাস্তবায়ন করবে। যেসব জেলা ও উপজেলা এখন পর্যন্ত করোনার সংক্রমণমুক্ত রয়েছে, সেসব এলাকায় বহিরাগতদের আগমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যুক্তিসঙ্গতভাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যাবে। চলাচল নিষেধাজ্ঞাকালীন জনসাধারণ এবং সব কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি নির্দেশমালা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

এদিকে করোনায় আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত ব্যক্তিদেরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণে দেখা যায়, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে নারায়ণগঞ্জ। রাজধানীতে মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৬৭৪ জন আক্রান্ত এবং ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে; যা মোট আক্রান্তের ৫৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং মৃত্যুহারে ৫৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭২ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের, যা মোট আক্রান্তের ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং মৃত্যুহার ২২ দশমিক ০৪ শতাংশ। একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ১৬ এপ্রিল ১০ জনের। এরপর ১৮ ও ২১ এপ্রিল ৯ জন করে, ২৯ এপ্রিল ৮ জন এবং ২৩ এপ্রিল ও ২ মে ৭ জন করে মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে মৃত্যুহার কমতে শুরু করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, প্রথমে ঢাকায় সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। এরপর নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জে ব্যাপক ভিত্তিতে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য জেলায়ও পর্যায়ক্রমে সংক্রমণ ঘটেছে। একমাত্র রাঙামাটি সংক্রমণমুক্ত ছিল। এবার এই জেলাটিও সংক্রমণের তালিকায় যুক্ত হলো।
বিশ্বের সবগুলো দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি অভিন্ন উল্লেখ করে ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, প্রত্যেকটি দেশেই দুই-একজনের মধ্যে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। সেখান থেকে ধাপে ধাপে পরিবার, প্রতিবেশী হয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে। এখন আমাদের সংক্রমণ এড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সেটি করতে গেলে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। তাহলেই আমরা এটি প্রতিরোধে সক্ষম হবো। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

৬৪ জেলাতেই সংক্রমণ : ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলায় আক্রান্ত ১৬৮, গাজীপুর ৩২৮, কিশোরগঞ্জ ২০২, মাদারীপুর ৫৩, মানিকগঞ্জ ২৮, মুন্সীগঞ্জ ১৭০, নরসিংদী ১৬৭, রাজবাড়ী ২৩, ফরিদপুর ২১, টাঙ্গাইল ৩০, শরীয়তপুর ৫৪, গোপালগঞ্জ ৪৫, চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলায় ১১২, কক্সবাজার ৪০, কুমিল্লা ১৩০, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৫৬, লক্ষ্মীপুর ৪৫, বান্দরবান ৪, খাগড়াছড়ি ২, রাঙামাটি ৪, নোয়াখালী ২২, ফেনী ৭, চাঁদপুর ৩৭, সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে ২৯ জন, সুনামগঞ্জ ৩৫, হবিগঞ্জ ৭০, সিলেট ২৭, রংপুর বিভাগের রংপুর জেলায় ৮২, গাইবান্ধায় ২৪, নীলফামারী ৩১, লালমনিরহাট ৪, কুড়িগ্রাম ২২, দিনাজপুর ২৯, পঞ্চগড় ৮, ঠাকুরগাঁও ২০ জন, খুলনা বিভাগের খুলনা জেলায় ১৭, যশোর ৭৫, বাগেরহাট ২, নড়াইল ১৩, মাগুরা ৮, মেহেরপুর ৪, ঝিনাইদহ ৩৩, কুষ্টিয়া ১৮, চুয়াডাঙ্গা ১৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ বিভাগে ১৯৮, জামালপুর ৭৯, নেত্রকোনা ৬২, শেরপুর ২৭, বরিশাল বিভাগের বরগুনা ৩৩, ভোলা ৬, বরিশাল ৪৪, পটুয়াখালী ২৮, পিরোজপুর ৮, ঝালকাঠি ১০ জন, রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাটে ৩৪, পাবনা ১৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২, বগুড়া ১৮, নাটোর ১১, নওগা ১৭, সিরাজগঞ্জ ৪ ও রাজশাহীতে ২৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

রাজধানী ঢাকাসহ মৃত্যুর ঘটনা ২৬ জেলায় : করোনাভাইরাস সংক্রমণে গতকাল পর্যন্ত ১৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা ১০০ জন। ঢাকা জেলার ৩ জন, কিশোরগঞ্জে একজন, মাদারীপুরে ২ জন, নারায়ণগঞ্জে ৪১ জন, মুন্সীগঞ্জে ৪ জন, নরসিংদীতে ১ জন, টাঙ্গাইলে ৩ জন, শরীয়তপুরে ১ জন, চট্টগ্রামে ২ জন, কুমিল্লায় ৪ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন, নোয়াখালীতে ১ জন, সিলেটে ২ জন, মৌলভীবাজারে ৩ জন, রংপুর ও দিনাজপুরে ১ জন করে, মেহেরপুরে ১ জন, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে ৩ জন করে, রাজশাহীতে ২ জন এবং বরগুনা, পটুয়াখালী, জয়পুরহাট ও পাবনায় ১ জন করে মারা গেছেন।

আক্রান্ত ১১ হাজার ছাড়াল :গতকাল ৬ মে দেশে নতুন করে আরও ৭৯০ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১১ হাজার ৭১৯ জনে পৌঁছাল। একই সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টায় আরও তিনজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৮৬ জনে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন : করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত বুলেটিনে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, সর্বশেষ মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী। তাদের মধ্যে দু’জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি এবং একজনের ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। দু’জন ঢাকার ভেতরে এবং একজন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা। গত চব্বিশ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় ৬ হাজার ৭৭১টি এবং পরীক্ষা করা হয়েছে ৬ হাজার ২৪১টি। এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৯৯ হাজার ৬৪৬টি।

নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ থাকবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে : আইইডিসিআর গবেষণা এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল সংক্রান্ত কাজ করবে জানিয়ে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ অব্যাহত থাকবে এবং সেটি ভিন্ন আঙ্গিকে করা হবে এবং তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। হঠাৎ করে কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সংবাদ সম্মেলনে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

নমুনা পরীক্ষা হাতের নাগালে নিয়ে যাওয়া হবে : ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্র্যাকের সহায়তায় করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য বুথ তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪টি, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ৩টি এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালে ১টি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। বুথের সংখ্যা বাড়িয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবার হাতের নাগালে নিয়ে যাওয়া হবে।

আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, চব্বিশ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ১৮৪ জনকে। মোট আইসোলেশনের সংখ্যা এক হাজার ৭৯৪ জন। চব্বিশ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮৪ জন। এখন পর্যন্ত আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন মোট এক হাজার ৩২৭ জন। চব্বিশ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে তিন হাজার ৮৮৯ জনকে। এখন পর্যন্ত দুই লাখ এক হাজার ৭০০ জনকে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন থেকে গত চব্বিশ ঘণ্টায় ছাড়পত্র পেয়েছেন তিন হাজার ৮৭২ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট এক লাখ ৬০ হাজার ৫৬১ জন। বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৪১ হাজার ১৯৩ জন।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঘরে প্রবেশ করে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান-পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়া এবং কোয়ারেন্টাইনের শর্ত মেনে চলতে হবে।

Pin It