করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে মানুষ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটে, তখন সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেকে বেড়েছে, যা অস্বাভাবিক ঠেকছে অর্থনীতি গবেষকদের কাছে।
আগের মাসের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে গত জুন মাসে ৯ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এক মাসের হিসাবে এই অঙ্ক এ যাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এর আগে এক মাসে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৯ হাজার ৭২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকার।
এক তো মহামারীকাল, তার উপর মুনাফার উপর করের হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রির এই উল্লম্ফনের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত।
তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সঞ্চয়পত্র বিক্রির এই উল্লম্ফন সত্যিই অস্বাভাবিক।
“ভয়াবহ এই দুর্যোগের সময়ে সংসারের খরচ মেটাতে মানুষ যখন তার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিচ্ছে, তখন সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কাছেও মহামারীকালে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াটাকে ‘অস্বাভাবিক’ লাগছে।”
তবে এর দুটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
আহসান মনসুর বলেন, “প্রথমত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের একটি অংশ দিয়ে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে। আগেও কিনত, তবে এখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে।
“এছাড়া অন্য যে কোনো সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যেহেতু বেশি, সবাই এখানেই বিনিয়োগ করছে। ব্যাংকে ডিপিএস খুললে ৬ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যায় না। সেখানে সঞ্চয়পত্র কিনলে ১১ সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। ব্যাংকে টাকা রাখা ঝুঁকিও মনে করেন অনেকে। তাই নিরাপদ ভেবে সবাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারে।”
রেমিটেন্স বেড়ে যাওয়া কারণ হতে পারে কি না- এই প্রশ্নে জায়েদ বখত বলেন, “এটা একটা কারণ হতেও পারে। তবে তাতেও বিক্রি এত বেশি বাড়ার কথা নয়।”
মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “না, সে রকমও তো মনে হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর আমানতও তো বেশ ভালো।”
সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার এখন জাতীয় পরিচয়পত্র এবং টিআইএন (কর শণাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করেছে। তাছাড়া ব্যাংক হিসাব ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না।
“এখন আর কেউ ভুয়া নামে বা একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে না। সে কারণেই আমি বলছি, আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, কেন সঞ্চয়পত্র বিক্রি এত বাড়ছে,” বলেন জায়েদ বখত।
ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে গত কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল।
বিক্রির চাপ কমাতে গত বছরের ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে কমতে শুরু করে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়,
>> গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৫২ হাজার ৬৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা শোধ করা হয়েছে। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
> ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৩৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ কম।
>> ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ৯ হাজার ৩২২ কোটি ৮০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। সুদ-আসল বাবদ গ্রাহকদের শোধ করা হয় ৫ হাজার ৯০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
>> গত জুন শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মোট স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ১৩৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
(আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়)।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করার পর গত এপ্রিলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে আসে। ওই মাসে মোট ৬৬১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয় তার প্রায় দ্বিগুণ ১ হাজার ২৮৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। নিট বিক্রি ছিল ৬২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)।
অর্থাৎ এপ্রিল মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ৬২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বেশি গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদে পরিশোধ করা হয়েছে।
মে মাসে ৩ হাজার ২২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয় ২ হাজার ৭৯৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৩০ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
গত অর্থবছরের শেষ মাসে জুনে মোট বিক্রি মে মাসের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৯ হাজার ৩২২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।
ফাইল ছবিফাইল ছবি
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর মাস মার্চে মোট ৫ হাজার ৬২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি হয় ৬ হাজার ৭৭২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
জানুয়ারি ৭ হাজার ৩০৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ডিসেম্বরে ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা, নভেম্বরে ৫ হাজার ২৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং অক্টোবরে ৬ হাজার ১৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।
এছাড়া সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ১১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, অগাস্টে ৫ হাজার ২১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং গত অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৬ হাজার ৬ হাজার ৯১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বিক্রি কমায় বছরের মাঝামাঝিতে এসে সেই লক্ষ্য কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
কিন্তু জুন মাসে অস্বাভাবিক বিক্রির কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অর্থবছর শেষে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে।