যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ায় তার ফাঁসি কার্যকর করতে এখন কেবল সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।
ইতোমধ্যে কারাগার এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। খবর এসেছে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত রাখার। শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে কারগারের বাইরে দেখা গেছে সংবাদকর্মী আর সাধারণ মানুষের ভিড়। সবার নজর এখন কাশিমপুরের দিকে।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক রাতে বলেন, “সরকারি আদেশ বাস্তাবায়নে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময়ই প্রস্তুত আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ীই ফাঁসি কার্যকর করা হবে।”
তবে শুক্রবার রাতে ফাঁসি কার্যকরের সম্ভাবনা নেই বলে ইংগিত দেন তিনি।
কাশিমপুরে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হলে গাজীপুরের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাহেনুল ইসলামের কাছেও সরকারের নির্বাহী আদেশ আসবে। রাত ৮টা পর্যন্ত তেমন কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানান তিনি।
কারা বিধি ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাসেমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে তার সঙ্গে শেষবার দেখা করতে দেওয়া হবে পরিবারের সদস্যদের।
তবে রাত ৮টা পর্যন্ত কারা কর্তৃপক্ষ তাদের দেখা করতে ডাকেনি বলে কাসেম পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানান।
এ কারাগারের জেলার নাশির আহেমদ জানান, মীর কাসেম আলীর সিদ্ধান্তের কথা তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। সেখান থেকে যে নির্দেশনা আসবে, সে অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নেবেন।
প্রাণভিক্ষা চাইবেন না
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য মীর কাসেমকে ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছর মার্চে আপিল বিভাগেও সেই রায় বহাল থাকায় তিনি রিভিউ আবেদন করেন।
প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত মঙ্গলবার কাসেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিলে এ মামলার সব বিচারিক প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে।
সেদিন সন্ধ্যায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে পরদিন সকালে তা আসামিকে পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। কাসেম প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না তখনই তা জানতে চাওয়া হয়। এরপর বৃহস্পতিবার আবারও প্রশ্ন করা হলে সময় চান কাসেম।
কাশিমপুর কারাগার-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক শুক্রবার বিকাল সোয়া ৪টায় জানান, তারা মীর কাসেমের সিদ্ধান্ত জানতে পেরেছেন।
“আমরা দুপুরের পর আবারও তার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলাম। উনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রণভিক্ষা চাইবেন না।”
সব বিচারিক প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তি হওয়ায় কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়াই ছিল জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাসেমের প্রাণ বাঁচানোর শেষ সুযোগ।
তিনি প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ায় আদালতের রায় অনুসারে ফাঁসি কার্যকরে এখন আর কোনো বাধা থাকল না বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
ঢাকায় কয়েকজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সরকার এখন যে কোনো সময় আদালতের রায় কার্যকর করতে পারে।
কারাগার ঘিরে নিরাপত্তামীর কাসেমের সিদ্ধান্ত জানার পর বিকাল থেকেই হাজার হাজার উৎসুক জনতা ভিড় করতে শুরু করেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার কমপ্লেক্সের বাইরে। সেই সঙ্গে বাড়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের উপস্থিতি।
এরই মধ্যে কারাগারের প্রধান ফটক থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের সংযোগ সড়ক এলাকা পর্যন্ত র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশের টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়। সন্ধ্যার পর আশপাশের এলাকায় দোকানপাটও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ভিড়ের মধ্যে ‘কোনো অঘটন যাতে না ঘটে’ সেজন্য তাদের এ নিরাপত্তা।
“ফাঁসি কোথায় হবে তা কারা কর্তৃপক্ষের বিষয়। যেহেতু আসামি এ কারাগারে আছেন, এখানে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। পরিস্থিতির সুযোগে কোনো নাশকতা বা কোনো অঘটন যেন না ঘটে, সেজন্য আমারা সিকিউরিটি বাড়িয়েছি।”
রাত ৮টার দিকে একটি জলকামান নিয়ে পুলিশের একটি দলকে কারাগারের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
পুলিশ সুপার বলেন, “কাশিমপুর কারাগারে চারটি জেলখানা আছে। এখানে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি, হত্যা মামলার আসামি, যুদ্ধাপরাধীসহ বড় বড় অপরাধীরা আছেন। সে কারণে আমরা এখানে নিরাপত্তা বেশি রাখি।
“এখন যেহেতু হাজার হাজার মানুষের ভিড়, সে কারণে আমরা আরও বেশি সিকিউরিটি দিচ্ছি। আমরা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছি। আমরা টহল জোরদার করেছি, রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়েছি।”
মীর কাসেম আলী (ফাইল ছবি)
‘ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত’কাশিমপুর কারাগারের জেলার নাশির আহমদ জানান, মীর কাসেম আলীকে রাখা হয়েছে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর ৪০ নম্বর কনডেম সেলে।
“তিনি সুস্থ আছেন। কারাগারের চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। তাকে স্বাভাবিক খাবার দেওয়া হচ্ছে।”
কারাগারের এক কর্মকর্তা সন্ধ্যায় বলেন, মীর কাসেমের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি তারা নিয়েছেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের দক্ষিণ পূর্ব কোনায় ফাঁসির মঞ্চটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। মোম মাখানো দড়িতে আনুমানিক ওজনের বালির বস্তা বেঁধে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক মহড়া।
জল্লাদ শাহজাহান, রাজু, পল্টুসহ কয়েকজনকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
এই জল্লাদ দল এর আগে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করেছিল।
যে অভিযোগে ফাঁসি
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালে এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়ে।
একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।
ষষ্ঠ ফাঁসির অপেক্ষা
তেষট্টি বছর বয়সী মীর কাসেম হলেন ষষ্ঠ যুদ্ধাপরাধী, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চার দশক আগের অপরাধের কারণে যাকে ফঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে।
যে পাঁচজনের দণ্ড এর আগে কার্যকর করা হয়েছে, তাদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তবে ওই কারাগার খালি করে ইতোমধ্যে বন্দিদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগারে।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।
আর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।
তাদের দুজনের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
এরপর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় একই দিনে, গতবছর ২১ নভেম্বর। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের ছয় দিনের মাথায় গত ১১ মে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি বলেসে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।