সামাজিক-পারিবারিক কিছু সংকটের কারণে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না – আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী
ধর্ষণ একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বজনদের কাছেও নিরাপদ থাকছে না নারী-শিশু। কেন এমন হচ্ছে? কেন শিশুরা ধর্ষণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হলো? ধর্ষকরা কি আদৌ শাস্তির আওতায় আসছে? এমন প্রশ্ন ঘুরেফিরেই উঠছে দেশের সচেতন মহল থেকে। মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা বলছেন, ধর্ষণ দুর্বলের ওপর সবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা ও সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ভিকটিমকে হয়রানির কারণেই ধর্ষণ মামলার বিচার হয় না। এ ছাড়াও ধর্ষণ মামলার আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে বড় একটি কারণ বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামিপক্ষের সমঝোতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু দরিদ্র পরিবারের। আর্থিক প্রলোভনে তারা সমঝোতা করে। সামাজিকভাবে লজ্জা ও ভয়েও মীমাংসায় আগ্রহী হয় তারা। আবার অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষা বা প্রমাণ সংগ্রহের অভাবেও ভিকটিমের পক্ষে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা বাধ্য হয়েই অভিযুক্তের শর্ত মেনে সমঝোতায় যেতে বাধ্য হয়।
রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় ১১ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মোফাজ্জল ও ঝন্টু নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত বছরের ২ জুন তাদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সংশ্নিষ্ট থানা পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা শিশুটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকারও করে। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু পরের মাসের ১৯ তারিখে তারা আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পায়। আদালত সূত্রে জানা যায়, বাদী ও আসামিপক্ষের মধ্যে স্থানীয়ভাবে আপস-মীমাংসা হয়। সেই সূত্রেই তারা জামিন পায়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হচ্ছে না- এ তথ্য পুরোপুরি সত্যি নয়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব মামলা শেষ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ৪১টি বিচারিক আদালত বাড়ানো হয়েছে। সরকার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সামাজিক-পারিবারিক কিছু সংকটের কারণে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এখানে সাক্ষী একটি বড় বিষয়। তারা আদালতে আসতে চান না। সামাজিক বা পারিবারিকভাবে মীমাংসার ঘটনা ঘটলেই কেবল সাক্ষীরা আদালতে আসেন। এসব ঘটনায় বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই আদালতে তথ্য গোপন করে। আইনে বলা আছে- ধর্ষণ মামলা আপস-মীমাংসা করা যাবে না। তারপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, অপরাধীকে বাঁচাতে আপস-মীমাংসার মতো ঘটনা বন্ধে সরকার শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ বন্ধ এবং জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সামাজিক আন্দোলন জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে ঘরে-বাইরে, শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের নারী ও শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৩৯টি এবং হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি। এসবের এক-তৃতীয়াংশ ধর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা।
এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১৬ জন। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ৬৬ জন; ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৬১ নারীকে। আর ২০১৮ সালে সারা দেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৬৯৭ জন; গণধর্ষণের শিকার ১৮২ জন; ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাবে সারাদেশের আদালতে ঝুলে আছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দেড় লক্ষাধিক মামলা। বিচার চলছে ঢিমেতালে। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। সাজা পাচ্ছে হাজারে সাড়ে চারজন আসামি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ সংক্রান্ত ১৭ হাজার ২৮৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ভিকটিম ১৭ হাজার ৩৮৯ জন। এ সময় ৩ হাজার ৪৩০টি ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৮০ জনকে যাবজ্জীবন, ৫৭৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ ৬৭৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
দেশের ৬টি আদালতের ধর্ষণের বিচারিক অবস্থা নিয়ে গত বছর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেসরকারি সংগঠন নারীপক্ষ। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা, জামালপুর, ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, নোয়াখালীতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ সময় গবেষণাকর্মীরা ৭টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১১ হাজার ৮৬৪টি মামলা পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩’-এর অধীনে ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ধর্ষণ সংক্রান্ত ৯২০টি, ধর্ষণচেষ্টা সংক্রান্ত ১১৭টি, যৌন পীড়ন ৩৬৪টিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মোট চার হাজার ৪৯৬টি মামলা হয়। সিরাজগঞ্জে ধর্ষণ সংক্রান্ত ৫৩৬টি, ধর্ষণচেষ্টা ১৬৮টি, যৌন নিপীড়ন ৯১টিসহ মোট এক হাজার ৭৯৮টি মামলা দায়ের করা হয়। জামালপুরে ধর্ষণ সংক্রান্ত ৬০৭টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩২৫টি, যৌন নিপীড়ন ৭৭টিসহ মোট দুই হাজার ২৩১টি মামলা করা হয়। ঝিনাইদহে ধর্ষণ সংক্রান্ত ১৭৭টি, ধর্ষণচেষ্টা ৮১টি, যৌন নিপীড়ন ৬০টিসহ মোট মামলা হয়েছে ৭১৬টি। জয়পুরহাটে ধর্ষণ সংক্রান্ত ৯২টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩২টি, যৌন নিপীড়ন ২৫টিসহ মোট ৬৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়। নোয়াখালীতে ধর্ষণ সংক্রান্ত ২৬৫টি, ধর্ষণচেষ্টা ১৫১টি, যৌন নিপীড়ন ১১৪টিসহ মোট এক হাজার ৯৬১টি মামলা দায়ের করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে ছয় জেলায় সাজা পেয়েছে ধর্ষণ মামলায় ৪ জন এবং অন্যান্য মামলায় ১৮ জন।
এদিকে গত বছর একটি বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৫টি ট্রাইব্যুনালে গত ১৫ বছরে ৫ হাজার ৫০২টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই হাজার ৮৯৮টি। এসব মামলায় মোট সাজা হয়েছে ৮৮ জনের। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড ৬ জনের এবং যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে ৭৩ জনের।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা মনিটরিং করতে পুলিশ সদর দপ্তরে পৃথক একটি শাখা রয়েছে। ওই শাখার হিসাবে আদালতে বিচারাধীন ধর্ষণ মামলাগুলোর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৪ শতাংশ আসামির সাজা হয়। বাকিদের অধিকাংশই মামলা থেকে অব্যাহতি পায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মামলা চলা অবস্থায় মাঝপথে বাদীপক্ষ আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, এ রকম একাধিক বাদীপক্ষের সঙ্গে পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। একেকটি পরিবারের গল্প একেক রকম পাওয়া যায়। কিছু পরিবার আছে, যারা এলাকা পরিবর্তন করে অন্য কোথাও চলে গেছে। আবার অনেকেই ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে অথবা আর্থিক লেনদেনে সমঝোতা করে ফেলে।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান সমকালকে বলেন, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে অসংখ্য ধর্ষণ মামলা পরিচালনা করেছি। এখন দিন শেষে বলতেই পারি, ধর্ষণ মামলা নিয়ে অভিজ্ঞতা তিক্ত। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ধর্ষণ মামলায় মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশের শেষ পর্যন্ত সাজা হয়। বিচারহীনতাই ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, প্রত্যেক জায়গায় একজন নারীকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে অথবা একটা কিশোরীকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে- সে ধর্ষিত হয়েছে। যেটা আমরা চাই- আসামিই প্রমাণ করবে- সে নির্দোষ। রেপ কেসে এটাই কিন্তু হওয়া উচিত।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, ধর্ষণ মামলার অধিকাংশই সুবিচারের মুখ দেখে না। সবাই যে সমঝোতা করতে চায়, তা সত্যি নয়। এমন অনেক নারী আছেন, যারা বছরের পর বছর আদালত চত্বরে ঘুরে বেড়ান তার ওপর চলা নির্যাতনের সুবিচারের আশায়। তবে বিচার বিলম্বিত হলে আপস-সমঝোতার চাপ বাড়ে। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে আপসে রাজি হতে হয়। ধর্ষকের হুমকি-ধমকিও একটি বড় কারণ। ১৯৯৯ সালের ৪ মার্চ রাজধানীর মিরপুরের একটি বাসায় ৩ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ মামলার অভিযুক্ত আসামি সারোয়ার স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে। তবে ধর্ষিতা সেই শিশু তার ওপর চলা বীভৎসতা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। এখন তার বয়স ২৩ বছর। এখনও তিনি মাঝেমধ্যে মামলার তারিখে আদালত চত্বরে হাজির হন। তিনি নিজের ওপর চলা নৃশংসতার বিচার চান। যদিও তিনি জানেন না- এ জন্য তাকে আর কত অপেক্ষা করতে হবে!
অনেক সময় ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে না পারার কারণেও বিচার পান না ভিকটিম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা হলে ধর্ষণের শারীরিক প্রমাণ পাওয়া সহজ। দেরি হলে প্রমাণ বিলীন হয়ে যায়। তিনি বলেন, সাধারণত ধর্ষণের পর প্রভাশালীরা সালিশসহ নানা বাহানায় সময় পার করে। তারপর থানায় গেলে থানা নানাভাবে মামলা নিতে দেরি করে। ফলে ধর্ষণ প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু সমকালকে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বাদীপক্ষ মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ধর্ষণের ঘটনায় প্রায়ই সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে আপসের কথা শোনা যায়। তারপরও কেউ কেউ আছেন, যারা সুবিচার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্যোগেও সমঝোতা করেন ভিকটিম।
কেন বিচার হয় না- নারী নেত্রী ও নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির সমকালকে বলেন, ধর্ষণ ‘দুর্বল’-এ ওপর সবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার। এটাই মূলত তার বিচার না পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। তিনি বলেন, সমাজে এখনও ধর্ষণের জন্য মেয়েদের দিকেই আঙুল তোলা হয়। ধর্ষণের শিকার মেয়ে বা ওর পরিবারের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়- মেয়েটিই দোষী। সব মিলিয়ে এমন সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যেখানে মেয়েটি বিচার চাইতেই ভয় পাবে। আবার তার বিচারের জন্য যা যা আলামত ও সাক্ষ্য প্রয়োজন, সেটি দুর্বল করে দেওয়ার কাজটি শুরু থেকেই করা হয়। সর্বশেষ প্রমাণের অভাবে মামলা আর বেশি দূর এগোয় না।