ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে কৌশলে অনুপ্রবেশ করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পোষ্যরা।
অর্থের বিনিময়ে পদে ঢুকেই পর্যায়ক্রমে তারা দলের স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দরপত্রসহ যাবতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। রাতারাতি মালিক বনেছে বিপুল অর্থসম্পদের। দলীয় পদ আর অঢেল অর্থের যুক্ত প্রভাবে স্থানীয় প্রশাসনও বলতে গেলে এখন তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে।
দল টানা সাড়ে এগারো বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এখন তারা রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর দাপটের কাছে অনেকটা অসহায় বা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দলের প্রকৃত ও বহু বছরের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বারবারই দলে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। কয়েক দিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যত অপকর্ম এই অনুপ্রবেশকারীরাই ঘটাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও নিয়মিতই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বলছেন।
বিভিন্ন স্তরে দলের অপূর্ণাঙ্গ কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তালিকা পাঠানোর যে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ছিল, তাতেও অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন ওবায়দুল কাদের। দলের প্রকৃত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা যাতে কমিটিতে স্থান পান, সে বিষয়েও তিনি নির্দেশনা দেন। তবে জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড, ইউনিয়নসহ তৃণমূলের বিভিন্ন কমিটিতে কেন্দ্রীয় সেই নির্দেশনার প্রতিফলন পুরোপুরি নেই।
নানা কৌশলে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতরা ঢুকে পড়েছে বা ঢুকছে। বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টি, এমনকি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও কেউ কেউ জার্সি বদলে কোথাও কোথাও অনুপ্রবেশ করেছে। সম্প্রতি এমন খবর গণমাধ্যমেও এসেছে।
টাকার বিনিময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দরপত্রের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে রাজাকারদের পোষ্যদের কেউ কেউ। কোনো কোনো এলাকায় তাদের ভয়ে দলের অন্য কেউ দরপত্রে অংশ নেওয়ারও সাহস করেন না। শুধু সরকারি দপরত্র নিয়ন্ত্রণই নয়, এলাকায় চাঁদাবাজি, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক ব্যবসাও করছে এই অনুপ্রবেশকারী যুদ্ধাপরাধীদের ছেলে-নাতি-স্বজনসহ পোষ্যরা। তাদের অর্থ আর দলীয় পদের প্রভাববলয়ের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনও বলতে গেলে অসহায়।
কোথাও কোথাও এমন ঘটনাও ঘটেছে যে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করায় অন্যত্র বদলি হতে হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। দিনে দিনে এই অনুপ্রবেশকারীদের হাত এত লম্বা হয়েছে যে অনুগত না থাকলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও অন্যত্র বদলি করানোর ক্ষমতা রাখে।
অনুপ্রবেশকারীরা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে টাকার বিনিময়ে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থের বিনিময়ে তারা থাকছে অধরা। কোনো কোনো এলাকায় এমন ঘটনাও রয়েছে, সরাসরি খুনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও তারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের অর্থের দাপট দেখে বিস্মিত খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরই প্রশ্ন, এই অর্থের উত্স কী?
আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তির সংযোগ রয়েছে কি না, এমন সন্দেহও পোষণ করছেন দলের নেতাকর্মীরা। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা কোনো শক্তি নেপথ্যে এদের অর্থের জোগান দিচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েক দিন আগেও বলেছেন, ‘সুযোগসন্ধানী অনুপ্রবেশকারীরাই দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তাদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। সুসময়ের কোকিল দুঃসময়ে থাকে না। সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের জন্য অনুপ্রবেশকারীরাই দায়ী। তাই আমি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলব, দলের কোনো স্তরে কোনোভাবেই অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।’
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী যুদ্ধাপরাধীদের পোষ্যরা এখন স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনও নিয়ন্ত্রণ করে। জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচনেও কৌশলে দলীয় মনোনয়ন নিচ্ছে। কখনো দলের মনোনয়ন নিতে ব্যর্থ হলে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজেরা প্রার্থী হচ্ছে, কখনো পছন্দের অনুগত কাউকে প্রার্থী করে বিপুল অর্থ খরচ করে তাকে জিতিয়ে আনছে।
আসন্ন ইউপি ও পৌরসভা নির্বাচনেও অনুপ্রবেশকারীরা বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের পছন্দের লোককে প্রার্থী করতে আগে থেকেই মাঠে তত্পর। এজন্য গত কোরবানির ঈদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে অনুপ্রবেশকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু কিনে পাঠিয়েছে নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতে, স্থানীয় সরকারের আসন্ন বিভিন্ন নির্বাচন সামনে রেখেই এ কাজ করেছে অনুপ্রবেশকারীরা; নিজেদের প্রভাববলয় নির্বিঘ্ন রাখতে এটাও তাদের একধরনের অগ্রিম বিনিয়োগ।