অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ নিউ জিল্যান্ড। অপূর্ব সব লেক, সাগরে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো নীল জলরাশি, মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজ প্রান্তর আর ছোট-বড় পাহাড় মিলিয়ে প্রকৃতি যেন খুব যত্ন করে সাজিয়েছে দেশটি। সৌন্দর্যের সেই লীলাভূমিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেট পেল ইতিহাসের সুন্দরতম দিন।
বাস্তব কখনও কখনও কল্পনার চেয়ে সুন্দর। বাংলাদেশ দল এবার ছাড়িয়ে গেছে কল্পনার সুদূরতম সীমানাও।
স্বাধীনতার পর নতুন শুরুতে হাজারও প্রতিবন্ধকতা ঠেলে এগিয়ে চলা, আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন যুগের বিচরণ আর টেস্ট ক্রিকেটে ২১ বছরের পথচলায় এমন দিন আসেনি আগে। এমন জয় আর দেখেনি দেশের ক্রিকেট।
নির্মল প্রকৃতির মতো বিশুদ্ধ নিউ জিল্যান্ডের মানুষও। জটিলতা তাদের স্পর্শ করে না। বিনয়ী, হামবড়া ভাব নেই একদমই। ক্রিকেট দলটাও দেশ আর মানুষের প্রতিচ্ছবি যেন। প্রতাপ ব্যাপারটি তাদের চরিত্র আর ধরনের সঙ্গে খুব যায় না। নইলে এই দলকে দেশের মাঠে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বলাই যায়। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাধারী তারা, মানে টেস্টের বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। দেশের মাঠে প্রায় অপ্রতিরোধ্য, হারতেও ভুলে গিয়েছিল। সেই দলকেই তাদের দেশে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ।
সফরকারী সব দলের জন্যই নিউ জিল্যান্ড সফর মানেই এখন প্রায় ‘মিশন ইম্পসিবল।’ উপমহাদেশের দলগুলির জন্য আরও বেশি। পাকিস্তান এখানে সবশেষ টেস্ট জিতেছে ২০১১ সালে। এই যে ভারত এখন বিশ্বজুড়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তারা এখানে সবশেষ জিতেছে ২০০৯ সালে। বিরাট কোহলির দল সবশেষ সফরে গিয়ে টেস্টে হয়েছে হোয়াইটওয়াশড। শ্রীলঙ্কা সবশেষ জিতেছে ২০০৬ সালে।
বাংলাদেশ সেখানেই জিতে গেল নিউ জিল্যান্ডের টানা ১৭ টেস্টের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা থামিয়ে।
সেই বাংলাদেশ, টেস্ট জয় যাদের কাছে অনেক সময়ই হয়ে ওঠে, ‘কত শত শতাব্দী দেখি না তোমার রূপ।’ সেই বাংলাদেশ, কোনো সংস্করণে কখনোই নিউ জিল্যান্ডকে হারাতে পারেনি তাদের দেশে। কোন সংস্করণে সেই খরা কাটতে পারে, বাজী ধরা হলে দরে নিশ্চিতভাবেই পাত্তা পেত না টেস্ট ক্রিকেট। বাংলাদেশ উল্টে দিল সেই পাশার দান।
সেই বাংলাদেশ, মাঠের ভেতরের বাজে পারফরম্যান্স আর বাইরের নানা বিতর্কে যারা জেরবার। নিউ জিল্যান্ডের উড়ানে ওঠার ঠিক আগেই মিরপুরে যারা পাকিস্তানের কাছে টেস্ট হেরেছে কার্যত আড়াই দিনের কম সময়ে। সেই দলই পাল্টা জবাব দিল দুঃসময়কে।
দলের সেরা ক্রিকেটার, যার অলরাউন্ড সামর্থ্য দলকে এনে দেয় ভারসাম্য, তিনি নেই এই সফরে। দলের সেরা ওপেনার, নিউ জিল্যান্ডে যার অভিজ্ঞতা অনেক, রেকর্ডও ভালো, তিনিও নেই এবার। মুমিনুল হকের দল দেখাল, আপাত চোখে ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও তারা নিধিরাম সর্দারের দল নয়।
বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনও বড় কোনো সাফল্য পায়নি। স্মরণীয় কিছু জয় অবশ্য আছে। তিন সংস্করণে, নানা সময়ে। বিভিন্ন জয়ের তুলনা করা কঠিন। নানা অর্জনে সেরা বাছাই করা কঠিন। তবু প্রেক্ষিত, পারিপার্শ্বিকতা আর বাস্তবতা মিলিয়ে এই জয়ের চেয়ে বড় জয় আর নেই। এই নিউ জিল্যান্ড বধের চেয়ে সেরা অর্জন আর নেই।
এমনিতে যিনি কখনোই এসব প্রসঙ্গে সরাসরি বা খোলামেলা কিছু বলেন না, তুলনায় যিনি বরাবরই বড় সাবধানী, সেই মুমিনুল হক পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনে অকপটে বলে দিলেন, এই জয়ই সেরা।
“হ্যাঁ, অবশ্যই, আমার কাছে তা-ই মনে হয় (শ্রেষ্ঠ অর্জন)। আপনার সঙ্গে আমি একমত। পরিস্থিতি যা, মানে যে অবস্থায় আমরা ছিলাম, সেই অবস্থা থেকে আমার মনে হয় এটা অনেক বড় (সাফল্য)। আর নিউ জিল্যান্ডের মতো কঠিন কন্ডিশনে আমাদের জন্য এটা অনেক বড় অর্জন।”
বছরের পর বছর নিউ জিল্যান্ড সফর থেকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। নান্দনিক সৌন্দর্যের দেশটির কন্ডিশন ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশের কাছে হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের প্রতিশব্দ। এবার মনের সেই জুজু তাড়াতে চেয়েছেন মুমিনুলরা। যদিও সিরিজের আগে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি বাস্তবতা মাথায় রেখেই। তবে ভিন্ন কিছু করার বিশ্বাস ভেতরে ছিল, বললেন অধিনায়ক।
“আসলে আমরা কখনোই ফল নিয়ে চিন্তা করিনি। আগেই যদি চিন্তা করেন যে নিউ জিল্যান্ডের মতো জায়গায় টেস্ট ম্যাচ জিতব, আমি হয়তো বলতে পারি, তবে সবাই বলবে, ‘পাগল হয়ে গেছে লোকটা।’ আমাদের দলের সবার ভেতর ছিল যে আমরা ভালো প্রস্তুতি নেই, প্রক্রিয়া অনুযায়ী খেলি।”
“কোথাও খেলতে হলে আগে চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার রাখতে হবে। আমরা যদি ভাবি যে নিউ জিল্যান্ড বা ইংল্যান্ডে খেলছি বা উপমহাদেশের বাইরে গেলেই কাজটা কঠিন, তাহলে কঠিনই হবে। আমরা ফলাফলে নজর দেইনি। মনোযোগ ছিল প্রক্রিয়ায়। দল হিসেবে পাঁচদিন কীভাবে খেলব, এসব নিয়েই ছিল ভাবনা ও লক্ষ্য।”
বাংলাদেশের এই জয়ের একটি বড় বিশেষত্ব, দলের অনেকের সম্মিলিত অবদান। আগের বেশির ভাগ বড় জয়ই ছিল ২-৩ জনের অসাধারণ ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ফসল। এবার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে ম্যান অব দা ম্যাচ ইবাদত হোসেন, তবে পারফর্ম করেছেন আরও অনেকেই। ম্যাচের নানা বাঁকে, নানা পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছেন কেউ না কেউ। এমনকি শরিফুল ইসলাম, দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট না পেলেও শেষ দিকে নিয়েছেন দুর্দান্ত ক্যাচ। বদলি হিসেবে ফিল্ডিং করতে নেমে তাইজুল ইসলাম মুঠোয় জমিয়েছেন অসাধারণ ক্যাচ।
এই জয় ‘সেরা’ হওয়ার যে নানা কারণ, সেখানে ভবিষ্যতেও যোগ হতে পারে অনেক কিছু। এই যে সবচেয়ে বাজে বোলিং গড়ের বোলার থেকে ইবাদতের নায়ক হয়ে ওঠা, দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমেই মাহমুদুল হাসান জয়ের দেয়াল হয়ে ওঠা, লিটন দাস দুর্দান্ত ফর্মের ধারাবাহিকতা এখানেও ধরে রাখা, শরিফুলের ঝলক, তাসকিন-শান্ত-মুমিনুল-মিরাজ, সবার অবদান, এই জয় ভবিষ্যতের জন্যও হতে পারে বড় জ্বালানী। কঠিন অভিযানে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই জয় দলকে করে তুলতে পারে সত্যিকারের ‘টিম বাংলাদেশ।’ এই আত্মবিশ্বাস দলে এনে দিতে পারে নতুন দিনের হাওয়া।
তেমন কিছুর স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে মুমিনুলের মনেও। ছাপ রেখে যাওয়ার কথা, ইতিহাসে দাগ কাটার কথা বললেন তিনিও।
“গত ২ বছরে আমরা খুব ভালো খেলতে পারিনি। সবাই জিততে মুখিয়ে ছিল। আমাদের জন্য জেতাটা জরুরি ছিল। আমরা এই টেস্ট জিততে মরিয়া ছিলাম লিগ্যাসি গড়ার জন্যও। আমার কাছে মনে হয়, এটা আমাদের টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি করার একটা ইঙ্গিত হতে পারে।”
কে জানে, আজ থেকে বহু বছর পর হয়তো পেছন ফিরে তাকিয়ে বলা হবে, মাউন্ট মঙ্গানুই জয় থেকেই শুরু হয়েছিল নতুন চূড়ার পথে বাংলাদেশের অভিযান!