সাকিবের অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ও মাইলফলক ছোঁয়ার ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়াল বাংলাদেশ।
তাইজুল ইসলামের মিডল স্টাম্পের ডেলিভারি রিভার্স সুইপের চেষ্টা করলেন জস বাটলার। ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বল ছোবল দিল প্যাডে। বাংলাদেশ দল উদযাপন শুরু করে দিল তখনই। আম্পায়ার আঙুল তোলার পর গোটা দলের সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ল মাঠে উপস্থিত দর্শকেরাও। খেলা তখনও শেষ নয়, তবে বাতাসে তখনই রেশ। জয়ের পথে সম্ভাব্য শেষ কাঁটা যে সরানো হয়ে গেল ওই উইকেটে!
জয়ের মঞ্চটা তৈরি করে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। ব্যাট হাতে দারুণ ইনিংসে দলকে এনে দেন লড়ার রান। বল হাতেও তিনিই সেরা। সঙ্গে অন্যদের পারফরম্যান্স মিলিয়ে শেষটা জয়ে রাঙাতে পারল বাংলাদেশ। আগেই হেরে যাওয়া সিরিজে হোয়াইটওয়াশ এড়ানোও গেল।
তিন ম্যাচ সিরিজের শেষটিতে চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডকে ৫০ রানে হারাল বাংলাদেশ।
জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে সোমবার ২৪৬ রানের পুঁজি নিয়ে ইংল্যান্ডকে ১৯৬ রানে থামায় বাংলাদেশ।
আরও একবার বাংলাদেশের মুখরক্ষার নায়ক সাকিব। আগেই সিরিজ হেরে যাওয়ার কারণেই হয়তো গ্যালারি এ দিন অর্ধেকেরও বেশি খালি ছিল পুরো সময়। তবে যারা এসেছিলেন মাঠে, সাকিবের দ্যুতিময় অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের আলোর ছোঁয়া পান তারা।
ব্যাটিংয়ে দলের হাল ধরে এগিয়ে নেওয়া ও দ্রুত রান তোলা, দুটি দায়িত্বই সামলান তিনি ৭১ বলে ৭৫ রানের ইনিংসে। তার পরও খুব হৃষ্টপুষ্ট হয়নি দলের রান। এবার বল হাতেও ত্রাতা তিনিই। ফিল সল্টকে ফিরিয়ে প্রথম ব্রেক থ্রুসহ ১০ ওভারে ৩৫ রান খরচায় নেন ৪ উইকেট। ম্যাচ সেরা তিনি ছাড়া আর কে!
এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো একই ম্যাচে ফিফটি ও ৪ উইকেট নিলেন তিনি। ওয়ানডে ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। ওয়ানডে ইতিহাসের তৃতীয় অলরাউন্ডার হিসেবে পূর্ণ করেছেন ৩০০ উইকেট ও ৬ হাজার রানের ডাবল।
অলরাউন্ড নৈপুণ্যের দিনে বোলিংয়েও বাংলাদেশের প্রথম হিসেবে তিনি ছুঁয়েছেন ৩০০ উইকেটের মাইলফলক।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের হয়ে এ দিন সাকিব ছাড়াও ফিফটির দেখা পান নাজমুল হোসেন শান্ত (৭১ বলে ৫৩) ও মুশফিকুর রহিম (৯৩ বলে ৭০)। তার পরও দলের রান ছুঁতে পারেনি আড়াইশ।
সিরিজে টানা তৃতীয়বার টস জেতেন তামিম ইকবাল। ব্যাট করতে নেমে শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি বাংলাদেশের। আগের ম্যাচের মতোই টপ অর্ডার নাড়িয়ে দেন স্যাম কারান।
প্রথম ওভারেই কারানের বলে বাজে শটে আউট হন লিটন দাস। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবার তিনি টানা দুই ম্যাচে ফিরলেন শূন্য রানে।
ভুলে যাওয়ার মতো সিরিজে তিন ম্যাচে স্রেফ ৭ রান করতে পারলেন এই ওপেনার। দ্বিতীয়বারের মতো কোনো সিরিজে ১০ রানও করতে পারলেন না তিনি। ২০১৯ সালে নিউ জিল্যান্ড সফরে তিন ওয়ানডেতে তার সংগ্রহ ছিল স্রেফ ৩ রান।
কারানের দ্বিতীয় ওভারে প্রথম তিন বলে ১৩ রান পায় বাংলাদেশ। তবে ওই ওভারেই দ্বিতীয় শিকারের দেখা পান তিনি। অন সাইডে খেলতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে তামিম ইকবাল (৬ বলে ১১) ধরা পড়েন পয়েন্টে।
তিন ওভারে দুই ওপেনারকে হারিয়ে চাপে পড়ে যাওয়া দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন মুশফিক ও শান্ত। তৃতীয় উইকেটে দুজন মিলে যোগ করেন ৯৮ রান।
এই জুটির শুরুটাও খুব একটা স্বস্তির ছিল না। তবে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেন দুজন। ধীরে ধীরে এগিয়ে নিতে থাকেন দলকে।
প্রথম ওয়ানডের মতো শেষটিতেও ফিফটি করেন শান্ত। মাইলফলকে পৌঁছতে খেলেন ৬৯ বল, মারেন ৫টি চার। মুশফিকও পৌঁছে যান পঞ্চাশের দোরগোড়ায়।
জমাট জুটিতে যখন রানের গতি বাড়ানোর পালা, তখনই ভুল বোঝাবুঝিতে বিদায় শান্তর। আদিল রশিদের বলে তিনি সুইপ করতেই দৌড় শুরু করেন মুশফিক। সেটি যেন দেখতেই পাননি শান্ত।
মুশফিককে দেখে যখন দৌড় শুরু করেন তিনি, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ডাইভ দিয়ে নন স্ট্রাইক প্রান্তে ক্রিজে ঢোকার আগেই বাটলারের থ্রো ধরে স্টাম্প ভেঙে দেন রেহান আহমেদ। ৭১ বলে ৫৩ রানে ফেরেন শান্ত।
ওই ওভারেই ক্যারিয়ারের ৫১তম ফিফটি পূরণ করেন মুশফিক। পঞ্চাশ ছুঁতে তিনিও খেলেন ৬৯ বল। ইনিংসটি দারুণ জরুরি ছিল তার নিজের জন্য। আগের ৭ ওয়ানডে ইনিংসে তিনি ২৫ ছাড়াতেও পারেননি।
শান্ত ফিরে যাওয়ার পর জমে ওঠে সাকিব ও মুশফিকের জুটি। কিন্তু দলীয় দেড়শ পেরোতেই মুশফিককে ফেরান রশিদ। ইংলিশ লেগ স্পিনারের গুগলিতে সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটের নিচ দিয়ে বোল্ড হন কিপার-ব্যাটসম্যান।
মুশফিকের সম্ভাবনাময় ইনিংসটি থামে ৭০ রানে। সাত ইনিংস পর পাওয়া ফিফটিতে ৯৩ বল খেলে ৬টি চার মারেন তিনি।
এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। আদিল রশিদকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কার পর এই লেগ স্পিনারের স্লাইডারে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান বোল্ড হন ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে।
৩৫ ওভারের মধ্যে পাঁচ ব্যাটসম্যানের বিদায়ের পর ইনিংসের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেন সাকিব। আফিফ হোসেনের সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে যোগ করেন ৪৯ রান। যেখানে আফিফের অবদান স্রেফ ১৫ রান।
কারানের ৩৮তম ওভারে জোড়া চার মারেন সাকিব। প্রথম বলে রানের খাতা খোলার পর টানা ৯ বল ডট খেলেন আফিফ। এরপর রেহানের বলে প্রথম বাউন্ডারির দেখা পান তিনি। তরুণ লেগ স্পিনারকেই মারেন নিজের দ্বিতীয় চার।
ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েও পারেননি আফিফ (২৪ বরে ১৫)। মেহেদী হাসান মিরাজও থামেন অল্পে। তাকে ফিরিয়ে প্রথম ওয়ানডে উইকেটের স্বাদ পান ইংল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে অভিষিক্ত লেগ স্পিনার রেহান আহমেদ।
মিরাজ আউট হওয়ার আগেই টানা দ্বিতীয় ফিফটিতে পা রাখেন সাকিব ৫৫ বলে। সেখানে না থেমে দলকে আড়াইশর কাছে এগিয়ে নেওয়ার কৃতিত্ব তারই।
৭১ বলে ৭ চারে ৭৫ করে শেষের আগের ওভারে তিনি থামেন লং অনে জেসন রয়ের অসাধারণ ক্যাচে। সাকিবকে আউট করার পরে বলে মুস্তাফিজুর রহমানকেও ফিরিয়ে বাংলাদেশকে গুটিয়ে দেন আর্চার।
রান তাড়ায় দারুণ শুরু করেন ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার জেসন রয় ও ফিল সল্ট। নবম ওভারেই চলে আসে দলের ৫০ রান।
আগের দুই ম্যাচে রান না পাওয়া সল্ট এই ম্যাচে আগ্রাসী শুরু করেন। তবে তাকে বেশি দূর যেতে দেননি সাকিব। ৭ চারে ২৫ বলে ৩৫ রান করেন এই ওপেনার।
প্রথম ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান দাভিদ মালানকে এবার শূূন্যতে থামান তাসকিন আহমেদের জায়গায় একাদশে ফেরা ইবাদত হোসেন।
পরে ইংল্যান্ডকে আরও চেপে ধরেন সাকিব। দুর্দান্ত ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড করে দেন আগের ম্যাচের নায়ক রয়কে। তার জোরের ওপর করা আন্ডার কাটারে ব্যাট লাগাতে পারেননি এই ওপেনার (৩৩ বলে ১৯)।
স্রেফ ৮ বলের মধ্যে ১ রানের ব্যবধানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় ইংলিশরা। ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া স্যাম কারান পাঁচে নেমে চেষ্টা করেন জেমস ভিন্সের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ার।
বাংলাদেশের আঁটসাঁট বোলিংয়ে সেভাবে হাত খুলে খেলতে পারেননি ভিন্স ও কারান। তারা দুজন মিলে ৪৯ রান যোগ করতে বল খেলেন ৮১টি। বিপজ্জনক হওয়ার আগেই এই জুটি ভাঙেন মিরাজ। ১টি করে চার-ছয়ে ২৩ রান করতে ৪৯ বল খেলেন কারান। থিতু হয়ে যাওয়া ভিন্সকে ৩৮ রানে থামান সাকিব।
পরের ওভারে ইবাদতের হাফ ভলিতে লেগ সাইডে খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান মইন আলি। ১৩০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে গভীর বিপদে ইংল্যান্ড।
বাটলার টিকে ছিলেন বলে তবু জিইয়ে ছিল ইংল্যান্ডের আশা। ওকসের সঙ্গে মিলে দলকে পথে রাখার চেষ্টা করেন ইংলিশ অধিনায়ক। কিন্তু তাইজুলের বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ইংলিশ অধিনায়ক এলবিডব্লিউ হলে কার্যত শেষ হয়ে যায় দলের আশা (২৪ বলে ২৬)।
ওকস পরে ৩৪ রানের ইনিংস খেলে কিছুটা কমান ব্যবধান। তার পরও দুইশ ছুঁতে পারেনি ইংল্যান্ড।
রেহান আহমেদকে ফিরিয়ে সাকিব পূর্ণ করেন ৩০০ উইকেট। সিরিজে প্রথম উইকেট নিয়ে খেলা শেষ করে দেন মুস্তাফিজুর রহমান। সিরিজ হারলেও জয়ে শেষ করার স্বস্তিটুকু পায় বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৪৮.৫ ওভারে ২৪৬ (তামিম ১১, লিটন ০, শান্ত ৫৩, মুশফিক ৭০, সাকিব ৭৫, মাহমুদউল্লাহ ৮, আফিফ ১৫, মিরাজ ৫, তাইজুল ২, ইবাদত ১*, মুস্তাফিজ ০; কারান ৮-১-৫১-২, ওকস ৮-০-২৭-১, আর্চার ৮.৫-১-৩৫-৩, মইন ৯-০-৪৮-০, রেহান ১০-০-৬২-১, রশিদ ৫-০-২১-২)
ইংল্যান্ড: ৪৩.১ ওভারে ১৯৬ (রয় ১৯, সল্ট ৩৫, মালান ০, ভিন্স ৩৮, কারান ২৩, বাটলার ২৬, মইন ২, ওকস ৩৪, রশিদ ৮, রেহান ২, আর্চার ৫*; মুস্তাফিজ ৬.১-০-২৫-১, তাইজুল ১০-০-৫২-২, ইবাদত ৯-১-৩৮-২, সাকিব ১০-০-৩৫-৪, মিরাজ ৮-০-৪৬-১)
ফল: বাংলাদেশ ৫০ রানে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে ইংল্যান্ড ২-১ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান
ম্যান অব দা সিরিজ: আদিল রশিদ
