তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সরকারের ‘সাজানো নির্বাচনি ফাঁদে’ জনগণ পা দেবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রোববার এক আলোচনাসভায় তিনি বলেন, ওরা (আওয়ামী লীগ সরকার) পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনিব্যবস্থা এমনভাবে সাজিয়েছে যে, তাতে দেখা যাবে এটা (নির্বাচন) খেলা ও তামাশা হবে। সেই তামাশায় তারাই নির্বাচিত হয়ে আসবে। তাই তাদের ফাঁদে দেশের মানুষ আর পা দেবে না। ‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান’-এবার সেটা হবে না।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে জাগপা। দলটির একাংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে এবং মহাসচিব এসএম শাহাদাতের সঞ্চালনায় আলোচনাসভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশের অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী, গণদলের এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী, ডিএলের সাইফুদ্দিন মনি, ন্যাপের এমএম শাওন সাদেকী প্রমুখ।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের হাতে সময় খুব কম। আবার তারা একটা নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। দুনিয়াকে দেখাবে তারাও নির্বাচন দিয়েছে। এবার এটা হবে না। আমরা যে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট চেয়েছি, সেটা দিতে হবে।
তিনি বলেন, তারা কত প্রতারক, ভন্ড। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট নিয়ে তারা কম দুষ্টামি করেছে, কম ভন্ডামি করেছে! যখন খায়রুল হক (ততকালীন প্রধান বিচারপতি) বললেন, এটা নাকি চলবে না, সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টের কমিটি করে সেই সময় সংসদের দলগুলোর মতামত চাইল। আওয়ামী লীগসহ সবাই মতামত দিলেন কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট থাকা উচিত। আরও দুইটা নির্বাচন হতে পারে। আর সেটা যখন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গেল, উনি (প্রধানমন্ত্রী) উলটে দিলেন। তিনি বলে দিলেন, না, এটা হবে না। এটা এখন দলীয় সরকারের অধীনে হবে। কর্তৃত্ববাদ-জমিদারি কাকে বলে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা-অবিশ্বাসের কারণেই ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন। এর প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাচ্ছি। মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দিয়ে একটা পার্লামেন্ট গঠন করতে পারে, সেজন্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চাচ্ছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের জনসভা করতে বাধা দেয় না। ওইটা আরেকটা শয়তানি। নতুন নাটক। বিএনপির কর্মসূচির দিন ওরা পাশে একটা সমাবেশ করে। এর নাম দিয়েছে শান্তি সমাবেশ। এই শান্তি সমাবেশ দিলেই মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর গড়া শান্তি কমিটির কথা মনে পড়ে। যাদের কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও গ্রেফতার করা। সেইভাবে তারা প্রতারণা করছে, মানুষকে বোকা বানাচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, আমার অন্তরে নাকি বিষ। আমরা সত্যি কথা বললেই তাদের গায়ে আগুন লেগে যায়। আমি তাদের অতীত ও বর্তমান মনে করিয়ে দিই। এই আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে যখন সবদিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, কোনোদিকে সামাল দিতে পারেনি; তখন সংবিধানটাকে তারাই কাটাছেঁড়া করে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, তারপর জরুরি অবস্থা আইন; শেষ পর্যন্ত তাতেও যখন হয়নি, তখন একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে। এটাই ইতিহাস।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র সহ্য করতে পারে না, আওয়ামী লীগ কখনো ভিন্নমতে বিশ্বাস করে না। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। একদলীয় শাসনব্যবস্থা করে সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করেছিল তারা। আজ আমার দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, এত চ্যানেল, এর কয়টায় গণতন্ত্রের কথা বলে, ভিন্নমতের কথা হয়? কয়টা পত্রিকায় ভিন্নমতের কথা বলা হয়?
মির্জা ফখরুল বলেন, আমি বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখছি। আওয়ামী লীগ ভয়ভীতি এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, যারা কথা বলত, তারাও এখন কথা বলেন না। অনেকে পত্রিকায় লেখে না। কী জানি কোন শব্দটা লিখলে তাদের আবার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হবে। খুব কষ্ট হচ্ছে এজন্য যে, আমাদের দেশের মানুষ এত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেল? কেন বলছে না-তুমি একটা এনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, একটা কর্তৃত্ববাদী শাসন জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছ।
সুশীল সমাজের উদ্দেশে তিনি বলেন, একজন মানুষকে হত্যা করলে কেন আপনারা কথা বলেন না? সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচনে পুলিশ ঢুকিয়ে দিয়ে আইনজীবীদের মেরে তাড়িয়ে দিল। একজনও বললেন না এটা অন্যায় হয়েছে। এরকম ভয় যদি থাকে, তাহলে এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই অবস্থা থেকে আমরা উঠে আসতে শুরু করেছি। আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে, বেগবান করতে হবে। আর চুপ করে থাকা যাবে না। জেগে উঠতে হবে। মানুষের অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
জিয়া পরিষদের আলোচনাসভা : এদিন বিকালে রাজধানীর একটি হোটেলে জিয়া পরিষদের আলোচনাসভায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এত কঠিন সময় আর আসেনি। সরকার জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। দেশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ সংকট উত্তরণ একমাত্র বিএনপির দায়িত্ব নয়। সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠন, বুদ্ধিজীবীসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
‘কর্তৃত্ববাদের উত্থান ও বিপন্ন গণতন্ত্র’ শীর্ষক আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডাক্তার মো. আব্দুল কদ্দুস। আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম, জিয়া পরিষদের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম সলিমুল্লাহ খান, ইউট্যাবের প্রেসিডেন্ট ও জিয়া পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম প্রমুখ। সভা সঞ্চালনা করেন জিয়া পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডক্টর মো. এমতাজ হোসেন।