সাধারণ রোগীদের কী হবে? মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা

image-149987-1588793684

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুরোটাই করোনা হাসপাতাল করা হচ্ছে। বার্ন ইউনিটের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট-২ কে এরই মধ্যে করোনার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। খুব শিগগিরই পুরো হাসপাতালটিকে করোনা হাসপাতাল করার ঘোষণা দেওয়া হবে। দেশের মোট চিকিত্সার ৭০ ভাগ চিকিত্সাই হয় এই হাসপাতালে। এখন প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ রোগীরা এখন যাবে কোথায়? বিভিন্ন রোগে এখন যারা চিকিত্সাধীন আছেন তাদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। এত রোগী সামাল দেওয়ার সক্ষমতা অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এটা ভুল সিদ্ধান্ত। দরিদ্র মানুষের চিকিত্সা হয় এখানে। ঢাকা মেডিক্যালে যদি সাধারণ রোগীরা চিকিত্সা না পায় তাহলে এখন তো করোনার চেয়ে অন্য রোগে মৃত্যু বেড়ে যাবে। এমনকি বিনা চিকিত্সায় মারা যাবেন সাধারণ মানুষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘এই হাসপাতালটি মায়ের মতো। এখানে এসে কেউ ফিরে যায় না। ধনী-দরিদ্র সবাই এখানে চিকিত্সা পান। এছাড়া এত রোগীকে চিকিত্সা দেওয়ার সক্ষমতা তো অন্য হাসপাতালগুলোর নেই। তাহলে এই রোগীরা কোথায় যাবেন? কীভাবে তাদের চিকিত্সা হবে—সেই প্রস্তুতি আগে নিতে হতো। পরিকল্পনার অভাবে অন্যভাবে ম্যানেজ করা যেত। সাধারণ মানুষের চিকিত্সার জন্য এটা করোনার বাইরে রাখতে হতো।’

২ হাজার ৬০০ বেডের এই হাসপাতালে প্রতিনিয়তই ৪ থেকে ৫ হাজার রোগী সব সময় ভর্তি থাকেন। এছাড়া জরুরি ও বহির্বিভাগে প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রতিদিন চিকিত্সা নেয়। এমন কোনো চিকিত্সা নেই যেটা ঢাকা মেডিক্যালে হয় না। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল এটি। প্রতিদিন ১০০-১৫০ অপারেশন হয়। ৭০ থেকে ৮০টি সিজার হয়। ডেলিভারি হয় আরো বেশি। শতাধিক কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস হয় এখানে। এখানে ক্যান্সার, হার্ট, লিভার, ওপেন হার্ট, কিডনি, বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্যাট, ডায়াবেটিস, নিউরোসার্জারি, নিউরোলজি, দুর্ঘটনায় হতাহতসহ এমন কোনো রোগ নেই যার চিকিত্সা এখানে মেলে না। করোনার এই সময়ে সাধারণ রোগীরা যখন অন্য কোনো সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সা পাচ্ছেন না, সেখানে ভরসার আশ্রয়স্থল ছিল এই হাসপাতাল। এখানে যারা চিকিত্সা নেন তাদের ৮০ ভাগই দরিদ্র। অধিকাংশকেই ফ্রি চিকিত্সা দেওয়া হয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখানে বিভিন্ন রোগের রোগীরা চিকিত্সা নেন। এই হাসপাতালটি গরিব মানুষের আশ্রয়স্থল। আমরা এখানে কোনো রোগীকে ফেরত দেই না। করোনার উপসর্গ নিয়ে এলে যেখানে অন্য হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করে না, সেখানে আমরা সব রোগীকেই চিকিত্সা দিয়েছি। সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে এখন আমরা করোনা রোগীদের চিকিত্সা করব। এখানে সম্মিলিত চিকিত্সাব্যবস্থা রয়েছে যা অন্য কোনো হাসপাতালে নেই। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে গাইনী, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনি, হূদেরাগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা রয়েছে। এসব কারণে এই হাসপাতালটি সরকার বেছে নিয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে।

গতকাল সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, সাধারণ রোগীরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই কাঁদছেন, কোথায় যাবেন? কীভাবে চিকিত্সা করাবেন? বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিত্সা করানোর সামর্থ্য নেই অধিকাংশ রোগীর। এখানে আরাম-আয়েশ নেই, কিন্তু উন্নতমানের চিকিত্সা মেলে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘যে রোগ নিয়ে যারা চিকিত্সা নিচ্ছেলেন তাদের আমরা ঐ সব রোগের বিষেশায়িত হাসপাতালে চলে যেতে বলেছি। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সেভাবেই চিকিত্সা কার্যক্রম চালাব। এখানে সব রোগের চিকিত্সাব্যবস্থা থাকার কারণে হয়তো সরকার এই হাসপাতালটিকে করোনার জন্য বেছে নিয়েছে।’

ঢাকা মেডিক্যালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘আসলে সঠিক পরিকল্পনাটা দরকার। যেভাবে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছে তাতে সামনে আরো বহু মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। করোনা রোগীদের ৯০ ভাগেরই শুধু অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু সাধারণ রোগীদের কথাও ভাবতে হবে। তাদের চিকিত্সার জায়গা থাকতে হবে। সরকার হয়তো সবকিছু বিবেচনা করেই এই হাসপাতালটি বেছে নিয়েছে। আমরা যেভাবে সাধারণ রোগের রোগীদের সাপোর্ট দিতে পারতাম এখন আর সেভাবে পারব না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এখন সাধারণ রোগীদের চিকিত্সা পাওয়ার জায়গা সংকুচিত হয়ে যাবে। অনেক রোগী চিকিত্সার জন্য পথে পথে ঘুরে মারা যাবেন। মন্ত্রণালয় যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিত তাহলে ঢাকা মেডিক্যালকে বাইরে রেখেই করোনা চিকিত্সাব্যবস্থা করা যেত। এখন সাধারণ রোগীদের সংকট কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। কারণ এই হাসপাতালে বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্যান্টের মাধ্যমে শত শত ব্ল্যাড ক্যানসারের রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।

বাংলাদেশ প্রাইভেট হসপিটাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, দেশে প্রায় ১৪ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। আমরা তো সরকারকে বলেছি, আমাদের এসব প্রতিষ্ঠান করোনা চিকিত্সার জন্য ছেড়ে দিতে রাজি আছি। সরকার তত্ত্বাবধানে নিয়ে এগুলো চালাক। আমরা তো সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সব ধরনের দুর্যোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বড়ো ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এটা সত্যি, এখানে সাধারণ গরিব রোগীদের চিকিত্সা হয়। কিন্তু এখন তো দেশে একটা দুর্যোগ চলছে। এই দুর্যোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বড়ো ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে। এখানে সব ধরনের চিকিত্সাব্যবস্থা আছে। এ কারণেই এই হাসপাতালকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

Pin It