ডাকাতি করতেই সাতজনের একটি দল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলীর উত্তর বাড়িতে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআই।
ওই হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সোমবার ফরহাদ (১৮) নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া ততেথ্যর বরাতে এ কথা বলেছেন পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার বশির আহমেদ।
ফরহাদকে সোমবার সকালে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা এটা ডাকাতির ঘটনা। টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কার নিতে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।”
গত ৫ জানুয়ারি রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা সারওয়ার আলীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ওই বাড়িতে ঢুকে। তৃতীয় তলায় গিয়ে তার মেয়ে সায়মা আলীর বাসার দরজায় তারা ধাক্কা দেয়।
দরজা খুললে মেয়ে ও জামাতাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা চেষ্টা চালায়। পরে বাড়ির চতুর্থ তলায় গিয়ে সারওয়ার আলী ও তার স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করে। প্রতিবেশীরা এসে তাদের উদ্ধার করে। পরে পুলিশ গিয়ে একটি মোবাইল ফোন ও একটি ব্যাগে থাকা সাতটি চাপাতি উদ্ধার করে। সে সময় বাড়ির দারোয়ান হাসান ও সারওয়ার আলীর গাড়িচালক ইসলামকে আটক করা হয়।
এই হামলায় জঙ্গিগোষ্ঠীত জড়িত থাকতে পারে বলে সারওয়ার আলীর সন্দেহ। ঘটনাটিকে ডাকাতিও মনে হয়নি তার কাছে।
এক প্রশ্নে পুলিশ সুপার বশির আহমেদ বলেন, “এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী সারওয়ার আলীর সাবেক গাড়ী চালক নাজমুল। তাকে গ্রেপ্তার করলে জানা যাবে এই ঘটনার সাথে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছ কিনা।”
তিনি বলেন, এ ঘটনায় মোট সাতজন জড়িত ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
“ফরহাদ বলেছে ঘটনার দিন তারা সাতজন আশকোনার একটি রেস্টুরেন্টে বসে ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। এর আগেও তারা এই রেস্টুরেন্টে বসে ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে। স্বর্ণালংকার, টাকা নেওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, হত্যা করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না বলে ফরহাদ জানিয়েছে।”
যে সাতজন জড়িত তার মধ্যে গ্রেপ্তার হাসান এবং হাফিজুল আছে কিনা জানতে চাইলে এ পিবিআই কর্মকর্তা জানান, তারা আলাদা। তবে সাতজনের সাথে নাজমুল আছে।
তিনি জানান, হামলার সময় দুজন বাড়ির ভেতরে গেলেও পাঁচজন বাইরে ছিল। তাছাড়া প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া দুইজনও তাদের সহযোগিতা করেছে।
তদন্তের দাবি
এদিকে সারওয়ার আলীর বাড়িতে হামলায় জঙ্গিরা জড়িত কিনা, সেটিকে প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত করার দাবি জানানো হয়েছে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে।
সোমবার বিকালে শাহবাগে ওই প্রতিবাদ সমাবেশে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “জঙ্গিরা যেভাবে বিভিন্ন মুক্তিবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করেছে, বা হত্যার চেষ্টা করেছে, এটা সেই রকম।
“আমার আরও মনে হচ্ছে যে তদন্ত হচ্ছে, এই হত্যাচেষ্টার পেছনে ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রাধান্য পেয়েছে, ”সেটি আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। আমি দাবি করব, সারওয়ার আলীকে হত্যাচেষ্টার পেছনে জঙ্গিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, পুলিশ সেটি খতিয়ে দেখবে এবং সে মতে ব্যবস্থা নেবে।”
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ”মুক্তিযুদ্ধের কারিগররা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হবে অথচ মৌখিক মুক্তিযুদ্ধের চর্চা হবে আর আদর্শিক মুক্তিযুদ্ধ দূরীভূত হবে এমন বৈপরীত্য নিয়ে বাংলাদেশ চলতে পারে না। এই হত্যচেষ্টার পরও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে কোনো উদ্যোগ দেখা না যাওয়াই আমরা শঙ্কিত, ক্ষুব্ধ।”
সারওয়ার আলীর বাড়ির ঘটনাকে ’দলীয় সুপরিকল্পিত হত্যা প্রচেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করে সমাবেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, “এই হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে নিকট অতীতে ধর্মীয় জঙ্গি সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা হুমায়ুন আজাদ ও অভিজিৎ রায়ের নিষ্ঠুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডসমূহের কিছু কিছু সাদৃশ্য রয়েছে।
”তাই এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসাবে লঘু করে দেখাটা মোটেও সমীচীন হবে না।“
ঘোষণাপত্রে বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ করে এই হত্যা প্রচেষ্টায় জড়িত ’হুকুমদাতা ও হুকুম পালনকারী’ সবাইকে গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে।
মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ”ডা. সারওয়ার আলীর উপর ভয়ঙ্কর অবস্থার তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে তার স্ত্রী মাখদুমা নার্গিস, তার সন্তানরা আর আশপাশের লোকেরা যদি সজাগ না হয়ে যেত, উপস্থিত বুদ্ধিতে সাথে সাথে যদি না ধরা হতো, আজকে হয়তবা সারওয়ার আলীকে আমাদের হারাতে হত।”
সারওয়ার আলীদের মতো মুক্তিবুদ্ধির পক্ষের শক্তির উপর আক্রমণের মাধ্যমে জঙ্গিরা ভয় ধরাতে চায় মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল তিনি বলেন, “যে আক্রমণ হয়েছে, সেটা অবশ্যই আমাদের ভয় দেখাবার জন্য। কারণ তারা জানে, ভয় না দেখিয়ে বাংলার মানুষের আনুগত্য কখনোই পাবে না। তাদের কথা-কাজ দিয়ে বাংলার মানুষকে কিনতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার অন্যতম কাজ হবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আমরা আপনাকে সে কথা ভুলতে দিব না। কারণ আমরা এখনো অতন্দ্র আছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জাগ্রত আছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের পরিচালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজুর রহমান, জাসদ নেতা নাজমুল হক প্রধান, জাতীয় শ্রমিক জোটের কার্যকরী সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ, মহিলা পরিষদের সহসভাপতি রেখা চৌধুরী বক্তব্য দেন।