“আজকে অনেকেই মিছিল মিটিংয়ে যায়, যখন আমরা সাহারা আপার নেতৃত্বে মিছিলে যেতাম, আপা আমাদের নিজে দেখে রাখতেন, খোঁজ খবর নিতেন। উনার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে চোখে শুধু সেই দিনগুলো ভাসছে, আমাদের বাঁচাতে গিয়ে মার খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন আপা… তিনি তো আমাদের অভিভাবক ছিলেন।”
আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কথা এভাবেই স্মরণ করলেন ঢাকা উত্তরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন।
তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা সাহারা খাতুন থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান।
বিয়ে-সংসারের প্রথাগত পথে না গিয়ে আজীবন মাঠের রাজনীতি করে যাওয়া এই নেত্রী কতটা মমতায় তার সহযোদ্ধাদের পরিচালিত করতেন, সে কথাই বার বার ঘুরে ফিরে আসছে শোকগ্রস্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কথায়।
তারা বলছেন, কেবল রাজপথে নয়, রাজনৈতিক ধরপাকড়ের কঠিন দিনগুলোতে আদালতে একজন আইজীবী হিসেবেও সাহারা খাতুন কর্মীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন সবার আগে।
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় জাকির হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মী। ‘সাহারা আপাকে’ হারানোর পর আজ তার সেইসব দিনের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে।
“নর্দা থেকে আমরা কয়েকজন কুড়িল গিয়ে আপার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিছিল করতাম। শুধু নব্বইয়ের আন্দোলন নয়, পরেও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে আমি সাহারা আপার সাথেই ছিলাম। এরশাদের পর বিএনপি এল, তখন নব্বইয়ের শুরুর দিকে, সাহারা আপাই এ এলাকায় সবার আগে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়তেন। উনি বের হলে আমাদের মধ্যেও সাহস জাগত।”
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মাঠের কর্মী সাহারাকেই প্রার্থী করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে সেবার তিনি জয়ী হতে পারেননি।
জরুরি অবস্থার পর দলের দুঃসময়ে আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হারানো আসন পুনরুদ্ধার করেন সাহারা। ঢাকা-১৮ আসন থেকে পর পর তিনবার তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
বছরের পর বছর মাঠের আন্দোলনে তাকে কাছ থেকে দেখার কথা স্মরণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিলেন সাহারা খাতুন, সেই থেকে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মাঠ ছাড়েননি।
“একজন নিরলস নির্ভিক, ত্যাগী নেত্রী ছিলেন। কোনো সময় আন্দোলন, কোনো সময় নির্বাচন, কোনো সময় সংগঠন- প্রতিটি কাজেই তার সরব উপস্থিতি ছিল।
চৌদ্দ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পাওয়া আমুর মূল্যায়নে, সাহারা খাতুন নিজেকে ‘জনগণের নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
“নেত্রী (শেখ হাসিনা) দেশে আসার পর, তার নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রামে কাজ করেছেন সাহারা খাতুন। তার সঙ্গে গ্রেপ্তারও হয়েছেন এবং নেত্রীও তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন। দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন তাকে।”
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে সাহারা খাতুনকে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন, তখন তা চমকের মতোই ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সাহারাকে।
ওই সরকারের শেষ পর্যায়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সাহারাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর সরকারে আর মন্ত্রীর দায়িত্ব না পেলেও দলে তাকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করে নেওয়া হয়।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে আওয়ামী লীগের যে কজন নেতা দলীয় সভানেত্রীর প্রতি আনুগত্য ধরে রেখে ছিলেন সক্রিয়, তাদেরই একজন সাহারা খাতুন।
দল ও দেশের জন্য নিজেকে ‘শতভাগ উৎসর্গ’ করেছিলেন বলেই তিনি একজন ‘আদর্শবান রাজনীতিবিদ’ এবং ‘জনগণের নেত্রী’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ।
এলএলবি পাস করে ১৯৮১ সালে আইন পেশায় যুক্ত হওয়া সাহারা খাতুন কাজ শুরু করেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে। জরুরি অবস্থার সময় শেখ হাসিনার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান সাহারা খাতুন বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন একসময়।
আইন পেশায় সাহারা খাতুনের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মামলার প্রয়োজনে সবার আগে পাওয়া যেত অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে।
“দুঃসময়ে আমাদের জন্য তিনি কী করেছেন সেটা বলার ভাষা আমার নেই। সব সময় রাজপথেই ছিলেন। টাকা পয়সা ছাড়া নেতাকর্মীদের মামলা ফেইস করতেন। তার মৃত্যুর পর থেকে খুবই খারাপ লাগছে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসও আইনজীবী হিসেবে কাছ থেকে দেখেছেন সাহারা খাতুনকে।
“আমি উনাকে খালা বলে ডাকতাম। তিনিও আমাকে সবসময় সন্তানের মত গভীর মমতায় আগলে রেখেছেন। তিনি আইনজীবী সমাজের জন্য পথ প্রদর্শক, অভিভাবক তুল্য। তার হাত ধরেই গড়ে উঠেছে বহু আইনজীবী, অনেক রাজনৈতিক অনুরাগী। তার মৃত্যুতে দেশের আইনজীবী পরিবার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অনতিক্রম্য শূন্যতা তৈরি হল, আমি হারালাম এক পরম আপনজন।”
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির স্মরণ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনে দেখা সাহারা খাতুনকে।
“গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচার করার জন্য প্রথমে তিন জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হল, সেই মামলাতে তিনি (সাহারা খাতুন) আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সবার আগে। ওই মামলায় যখন প্রথমে আমাকে গ্রেপ্তার করা হল, তখন সবার আগে যে আইনজীবীকে দেখেছি তিনি সাহারা খাতুন।
“যখন কোনো আইনজীবীই প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি এগিয়ে এসেছেন। সমস্ত দুঃসময়ে সাহারা খাতুন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমাদের সাহস যুগিয়েছেন, যতরকম আইনি সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তিনি আমাদের করেছেন। আমরা আমাদের একজন অভিবাবককে হারিয়েছি।”
শাহরিয়ার কবিরের ভাষায়, সকল আন্দোলনে মাঠের নেতা হিসেবে সামনে থাকা সাহারা খাতুনের সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তার ‘সততা’।
“এটা অনন্য দৃষ্টান্ত। মাঠ পর্যায় থেকে গড়ে ওঠা এমন নেতা দু একজন ছাড়া এখন আর নেই। সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ তো বটেই, পুরো জাতির জন্যই একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।”