বিএনপি-জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের প্রস্তাবিতরা উপাচার্য প্যানেলে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলেও সেখানে দলীয় সিদ্ধান্তের লংঘন ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আগামী চার বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে বুধবার সিনেট অধিবেশনে তিনজনের প্যানেল চূড়ান্ত হয়। সেখানে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল স্থান পেয়েছেন।
এই প্যানেল এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে পাঠানো হবে। তিনজনের একজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের একাংশ অভিযোগ করেছেন, দলীয় ফোরামে সর্বাধিক ভোট পাওয়া মুহাম্মদ সামাদের নাম তালিকায় সবার আগে থাকার কথা থাকলেও তা লংঘন করে উপাচার্য আখতারুজ্জামানের নাম দেওয়া হয়েছে। সিনেট অধিবেশনে এর প্রতিবাদ জানানো হলে সভাপতিত্ব করা আখতারুজ্জামান তা পাশ কাটিয়ে অধিবেশন শেষ করে দিয়েছেন।
প্রতিপক্ষহীন অধিবেশনে নীল দলের পক্ষে প্যানেল সদস্যদের নাম প্রস্তাব করেন বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। সিনেটে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এসএম বাহালুল মজনুন চুন্নু ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানান।
অধিবেশনে উপস্থিত সিনেট সদস্য ও টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, “বিকল্প প্যানেল না থাকায় আমরা গতকাল দলের থেকে যে প্যানেল চূড়ান্ত করেছিলাম শুধু ওই প্যানেলটাই সিনেটে প্রস্তাব করা হয় এবং সবাই এতে সমর্থন জানায়। তাই ভোটাভুটিতে যেতে হয়নি।”
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সিনেটে নীল দলের শিক্ষক প্রতিনিধি ও রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধিদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে নীল দলের প্যানেল ঠিক করা হয়। সেখানে নীল দলের ৫৩ জন সিনেট সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকে মোট পাঁচজন শিক্ষকের নাম প্রস্তাব করা হলে উপস্থিতদের ভোটে তিনজনের প্যানেল চূড়ান্ত করা হয়। এতে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, ৪২ ভোট। উপাচার্য আখতারুজ্জামান পেয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ ভোট এবং মাকসুদ কামালের পক্ষে পড়ে ৩০ ভোট।
অন্য দুজন বর্তমান উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ ২৮ ভোট এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান ২০ ভোট পেয়ে বাদ পড়েন।
ওই বৈঠকে সর্বাধিক ভোট পাওয়া মুহাম্মদ সামাদের নাম ১ নম্বরে রেখে ভোট অনুসারে প্যানেলের ক্রম ঠিক করার সিদ্ধান্ত হয় বলে বেশ কয়েকজন সিনেট সদস্য জানিয়েছেন।
তারা অভিযোগ করেন, ওই সিদ্ধান্ত লংঘন করে সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের নাম ১ নম্বর এবং অধ্যাপক সামাদের নাম ২ নম্বরে রেখে ‘জোরপূর্বক’ প্যানেল মনোনয়ন দেওয়া হয়।
সিনেটে এই প্রস্তাব তোলা হলে নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক এবং বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক মো. আব্দুল আজিজ এর প্রতিবাদ করেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুল আজিজ বলেন, “সিনেট অধিবেশনে আমি ফ্লোর চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়নি।”
নামের ক্রম পরিবর্তনের বিষয়ে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “নীল দলের যৌথ সভায় আমরা গতকাল ভোট করে একটি প্যানেল ঠিক করেছিলাম। সেখানে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে তার নামটি আগে, তারপর মধ্যম, তারপর তৃতীয়জন। আজকে যখন সিনেটের ফ্লোরে এই প্যানেলের নাম প্রস্তাব করা হয় তখন আমরা দেখলাম অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের নামটি প্রথমে এসেছে, যিনি ওই যৌথ সভায় ৩২ ভোট পেয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় স্থানে রাখা হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদের নাম। কিন্তু অধ্যাপক সামাদ সর্বোচ্চ ৪২ ভোট পেয়েছিলেন।
“তখন এটাকে সমর্থনও করলেন আমাদের রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি বাহালুল মজনুন চুন্নু। এই সময় আমাদের মাইক্রোফোন অন করেছিলেন আমাদের শিক্ষক ক্যাটাগরি থেকে সবচেয়ে প্রবীণতম শিক্ষক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। উনি বললেন যে, মাননীয় উপাচার্য আমাদের একটি কথা আছে, যেটা ক্রমানুসারে হয়নি। এটা উনি একবার নয় কয়েকবার বলেছিলেন, কিন্তু মাননীয় উপাচার্য সেই কথা শোনেননি।”
এক পর্যায়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সামাদও এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয় অভিযোগ করে সাদেকা হালিম বলেন, “উনি বললেন যে, এটা তো একটা অধিবেশন এখানে আমরা সবাই কথা বলতে পারি। এটা গণতান্ত্রিক চর্চার একটা জায়গা, এখানে আপনি সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেন। তখন উনি (উপাচার্য) বললেন যে, জাতীয় সংগীত বাজানো হোক। জাতীয় সংগীত যখন বাজানো শুরু হল তখন সকল সিনেটর জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং এভাবে অধিবেশনের সমাপ্তি হল।”
মঙ্গলবার নীল দলের যৌথ সভায় সমন্বয়ক হিসেবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট বাহালুল মজনুন চুন্নু এবং নীল দলের দুইজন যুগ্ম আহ্বায়ক সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ও সহকারী প্রক্টর আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান।
মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, “ওই নির্বাচনে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল তিনজন প্রতিনিধি বাছাইয়ে একজন ভোটার তিনটি ভোট দেবেন- এর কম বা বেশি নয় এবং প্যানেলের ক্রম প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
“সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ নম্বরে অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, ২ নম্বরে অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান এবং ৩ নম্বরে অধ্যাপক মাকসুদ কামালের নাম থাকার সিদ্ধান্ত হয়।”
এর আগে ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই সিনেট বৈঠকে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য নির্বাচনে তিন সদস্যের প্যানেল মনোনীত করেন।
কিন্তু এক রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর সেই বিশেষ সভা ও তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেলকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত ছয় মাসের মধ্যে যথাযথভাবে সিনেট গঠন করে উপাচার্য প্যানেল মনোনীত করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।
এর মধ্যেই ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে সাময়িক সময়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের আদেশ জারি করেন। তার আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্যের (প্রশাসন) দায়িত্বে ছিলেন।