স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী আবজাল হোসেন। অনিয়ম-দুর্নীতি করে তার ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছে। তার ধনসম্পদের উত্স অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘কেঁচো খুড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসল। জানা গেল, বড় একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পুরো স্বাস্থ্য খাত।
হাসপাতালের জন্য কি যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে, মেডিক্যালে ভর্তির বিষয়াদি, বিভিন্ন পদে নিয়োগ-বদলি, বিদেশে প্রশিক্ষণসহ সব কিছুই এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। সারাদেশের স্বাস্থ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরও সিন্ডিকেটের জিম্মায়। এরাই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছে। সমপ্রতি দুদকের জালে আটকা পড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেরানি-স্টেনোগ্রাফার আবজাল-রুবিনা দম্পতির সম্পদের পরিমাণ দেখে হতবাক সারাদেশের মানুষ। এই আবজালের আরেক সহযোগী আছেন, তারও দেশে-বিদেশে রয়েছে অঢেল সম্পদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দুদকের তদন্তে আবজাল-রুবিনা দম্পতির দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় মিলেছে। নামে-বেনামে আরও বিপুল সম্পদ থাকতে পারে বলে তাদের অনুমান।
অথচ আবজাল সাকল্যে বেতন পেতেন ত্রিশ হাজার টাকা। এই দম্পতির নামে ঢাকায় ১৪টি আলিশান বাড়ি ও প্লটের সন্ধান মিলেছে। দুদকে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী, আবজালের নামে ঢাকার উত্তরায় ১৫/সি সেক্টরে ২/বি সড়কে ২৪ ও ২৬ নম্বরে হোল্ডিংয়ে তিন কাঠার দুটি প্লট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এন ব্লকে ১২৫/এ নম্বরে চার কাঠার প্লট রয়েছে। খিলক্ষেতের ডুমনী মৌজায় একটি আবাসন কোম্পানিতে তিন কাঠা জমি, মিরপুরের পল্লবী থানাধীন বাউনিয়া মৌজায় ছয় কাঠা জমি, একই মৌজায় আড়াই কাঠা জমিতে টিনশেড বাড়ি আছে। এছাড়া তার নামে ফরিদপুরের কোতোয়ালি পৌরসভার রঘুনন্দনপুর মৌজায় সাড়ে ১৩ শতাংশ জমি, একই এলাকার হাবেলী মৌজায় সাড়ে ১০ শতাংশ জমিতে দোতলা বাড়ি, ফরিদপুরের টেপাখোলা ইউনিয়নে এক একর সাতাশ শতাংশ জমি, রাজবাড়ী জেলার বসন্তপুর মৌজায় ২ একর ৩০ শতাংশ জমি, খুলনার খালিশপুরে বয়রা মৌজায় সাড়ে পাঁচ কাঠা জমি আছে। সম্পদ বিবরণীতে আরও বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ৭ পন্টার স্টেটে একটি বাড়ি রয়েছে আবজালের। তার দূর সম্পর্কের মামা রাজশাহীর বদিউর রহমান বাড়িটি দেখাশোনা করেন। বনানীর জনৈক হুন্ডি ব্যবসায়ী লোকমানের মাধ্যমে ওই বাড়ি কেনার জন্য দুই লাখ ইউএস ডলার অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছেন তিনি।
সম্পদের দিক থেকে আবজালের চাইতে এগিয়ে স্ত্রী রুবিনা খানম। তার নামে ঢাকার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ১১ নম্বর সড়কে তিন কাঠা এক শতাংশ জমিতে ছয় তলা বাড়ি, একই সেক্টরের ১৬ নম্বর সড়কে তিন কাঠা জমিতে ছয় তলা বাড়ি, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩০৬৬ ও ৩০৬৭ ব্লক নম্বরে আছে তিন কাঠার দুটি প্লট। বাড্ডায় ১৮, জোয়ার সাহারায় এনআর কমপ্লেক্সে ১১৪৬ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, মিরপুরের বাউনিয়া মৌজায় ০২৪৭.৫ অযুতাংশ জমিতে টিনশেড বাড়ি, ১, বাউনিয়া মৌজায় আড়াই কাঠা জমি, সাভারের বিরুলিয়ায় ১৫ শতাংশ জমি, ফরিদপুরের কোতোয়ালি মৌজায় চরপশ্চিম টেপাখোলায় ৮ শতাংশ, ৯ শতাংশ ও সাড়ে ৫ শতাংশের তিনটি প্লট, ঢাকার কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগর খাজা সুপার মার্কেটে বিশাল দুটি দোকান, ফরিদপুরের কোতোয়ালি হাবেলী গোপালপুরে নির্মাণাধীন দোতলা বাড়ি আছে। কেরানির বউ হলেও রুবিনা খানমের রয়েছে ল্যাটেস্ট ব্র্যান্ডের হ্যারিয়ার গাড়ি। যার মডেল নম্বর ২০১৪ সিসি ২০০০।
অনুসন্ধানী কর্মকর্তারা জানান, আবজালের বয়স ৪৫ বছর। ১৯৯২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পাওয়া আবজাল আর পড়ালেখা করেননি। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে চাকরি পান তিনি। সেখানে পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে সমন্বয়কারীর কার্যালয়ে অস্থায়ীভাবে অফিস সহকারীর বদলি পদে কাজ শুরু করেন। এরপর কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে তাকে বদলি করা হয়। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চলতি দায়িত্বে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে মেডিক্যাল এডুকেশন শাখা মহাখালীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সাতক্ষীরায় বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আবার ঢাকায় চলে আসেন। জানা গেছে, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে আবজাল ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে নিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, আবজালের মতো যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করা করে শাস্তি দেওয়া হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কোন সিন্ডিকেটে কাজ হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিত্সা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ জানান, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন জায়গায় আবজালকে আমরা ঢুকতে দিতাম না। আবজালের বির’দ্ধে কর্তৃপক্ষ কমিটি গঠন করেছে। বর্তমানে তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই মন্ত্রণালয় থেকে অধিদফতর পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতের ঘাটে ঘাটে লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় কিন্তু লুটেরা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয় না। বরং ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজরা নতুন করে লুটপাটের মহোত্সবে মেতে ওঠে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মতো বিশাল দুটি প্রতিষ্ঠানে সারা বছরই চলে বদলিবাণিজ্য। এক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এছাড়াও স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, এসেনসিয়াল ড্রাগসসহ কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের অন্যান্য ইউনিট সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে জিম্মি।
এদিকে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে ওই সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট স্বাস্থ্য প্রকৌশল দফতরের যাবতীয় টেন্ডার কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ডিকেট এতটাই বেপরোয়া যে, নিয়মনীতি—আইনকানুন পরোয়া করে না। ইউনিয়ন পর্যায়ে, পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক, নতুন ভবন নির্মাণ ও মেরামতের কাজে সিডিউলবহির্ভূত নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তদারকি চলে ঢিমেতালে। বিভিন্ন নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজে টেন্ডার, পুনঃ টেন্ডার, পরীক্ষা, যাচাই-বাছাইসহ নানা অজুহাতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণের ব্যাপারেও অভিযোগ আছে।
দাফতরিক কর্মকান্ডে দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট চলার পাশাপাশি ইনস্টিটিউটের জায়গাজমি, গাছপালা, আসবাবপত্র পর্যন্ত গিলে খাচ্ছে। ইনস্টিটিউটের জায়গা ভাড়া দেওয়া, অবৈধ বস্তি বসানো, দোকানপাট বাজার গড়ে তোলাসহ বৃক্ষসম্পদ কেটে দেদার বিক্রি করার এন্তার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ন্যাশনাল ইলেক্ট্রো মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ (নিমিউ অ্যান্ড টিসি)। এটাও নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। টেন্ডার ঘোষণা ছাড়াই কোটি কোটি টাকার কাজ শত শত ভাগে বিভক্ত করে কেবলমাত্র রিসিট ভাউচারের মাধ্যমেই তা কেনাকাটার নামে হরিলুট চলে। টেন্ডারবাজির হরিলুটে সব প্রতিষ্ঠানকে হার মানাচ্ছে স্বাস্থ্য সেক্টরের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। সরকার সমর্থক স্বাধীনতা চিকিত্সা পরিষদের এক শ্রেণীর নেতা ও সিএমএসডি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেখানে নামমাত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভুয়া টেন্ডার প্রতিযোগিতা দেখিয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয় পূর্বনির্ধারিত ঠিকাদারকে।