বাজারে চাল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’ এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)।
রাষ্ট্রীয় এই গবেষণা সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উৎপাদন তথ্যের অসামঞ্জস্যও মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার ঢাকার ফার্মগেইটে বিএআরসি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন বিএআরসির গবেষণা দলের সমন্বয়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণ উপস্থাপন করেন কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের এসএসও আব্দুস সালাম, আলুর দাম বৃদ্ধির কারণ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক শেখ আব্দুস সবুর, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ উপস্থাপন করেন কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান আব্দুর রশীদ।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় চাল, পেঁয়াজ ও আলুর বাজারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ উদ্ঘাটনে বিএআরসি এই গবেষণা চালায়।
তাদের প্রতিবেদনে আলাদা করে চাল, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বাড়ার কারণ এবং তা ঠেকাতে কিছু সুপারিশ রাখা হয়।
চালের দাম বৃদ্ধি সম্প্রতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।চালের দাম বৃদ্ধি সম্প্রতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণ
>> প্রায় সকল কৃষকই ধান কর্তনের প্রথম মাসের মধ্যে বাজারজাতযোগ্য উদ্বৃত্তের একটা বড় অংশ বিক্রি করে দেন। কিন্তু গত বোরো মৌসুমে ধান বিক্রির ধরনটি পরিবর্তিত হয়েছে। এ মৌসুমে কৃষকরা তাদের ধান মজুদ থেকে ধীরে ধীরে বিক্রি করেছেন।
>> সরকার কর্তৃক কম চাল সংগ্রহ ও যথাসময়ে আমদানির ব্যর্থতা এবং প্রয়োজনীয় বাজার হস্তক্ষেপের অভাব মূল্য বৃদ্ধির কারণ ছিল।
ধানের বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণ
>> বড় মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য ও অসম প্রতিযোগিতা।
>> আমন মৌসুমে ধান উৎপাদনে ঘাটতির আশঙ্কা।
>> ধান চাষের ব্যয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ বৃদ্ধি।
>> ক্রমবর্ধমান মৌসুমী ব্যবসায়ী বৃদ্ধি।
>> প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন হ্রাস।
আলুর মূল্য বৃদ্ধির কারণ
>> ভবিষ্যতে মূল্য বৃদ্ধির আশায় কৃষক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলুর মজুদ ও হিমাগার থেকে আলুর কম সরবরাহ।
>> হিমাগারে মজুদকৃত আলুর পুনঃপুনঃ হস্তান্তর।
>> পাশের কয়েকটি দেশে আলু রপ্তানি
>> মৌসুমী ব্যবসায়ী কর্তৃক আলুর বিপুল মজুদ ও কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি।
>> আলুর বাজারে সরকারের সীমিত নিয়ন্ত্রণ ও বাজারের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্যের অভাব।
> বর্ষার মৌসুমের ব্যাপ্তি দীর্ঘতর হওয়ায় সবজির উৎপাদন হ্রাস ও আলুর চাহিদা বৃদ্ধি।
ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনছে মানুষ।ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনছে মানুষ।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ
>> দেশীয় অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেট দ্বারা বাজারে কারসাজি।
>> ভারতীয় রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা অথবা অতিমাত্রায় ভারতের উপর পেঁয়াজে আমদানির জন্য নির্ভরতা।
>> আমদানির জন্য পেঁয়াজের বিকল্প উৎসের সন্ধানে দ্রুত কার্যক্রমের অভাব।
>> গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও মুড়িকাটা পেঁয়াজের সীমিত উৎপাদন।
ধান-চাল নিয়ে সুপারিশ
>> ধান-চাল সংগ্রহ পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরিভাবে ধান সংগ্রহ করা ও মিলারদের মাধ্যমে তা চালে পরিণত করা।
>> চিকন ও মোটা দানার চালের জন্য সরকারের পৃথক ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এসএমপি) ঘোষণা করা।
>> ন্যূনতম ২৫ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা এবং মোট উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ সংগ্রহ করার সক্ষমতা অর্জন করা যাতে করে সরকার বাজারে কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
>> বাফার স্টক হিসেবে সরকার কর্তৃক প্রতি মাসে কমপক্ষে ১২ দশমিক ৫০ লাখ টন চাল মজুদ নিশ্চিৎ করা।
> উৎপাদন ব্যয়ের উপর কমপক্ষে ২০ শতাংশ মুনাফা বিবেচনা করে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা।
আলু নিয়ে সুপারিশ
>> কৃষি মূল্য কমিশন স্থাপন ও পরে সর্বাধিক ও সর্বনিম্ন সাপোর্ট মূল্যের ঘোষণা প্রদান।
>> উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ ও দামের তথ্যাবলীতে অস্পষ্টতা অপসারণ ।
>> হিমাগারে আলুর সংরক্ষণ ও অবমুক্তকরণ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে রাখা।
>> আলুর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের সনাক্তকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
>> আলু ও আলু দ্বারা তৈরি বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।
>> বিদেশে চাহিদাকৃত আলুর জাতের উন্নয়ন ও যেসব আলু প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত হয় সেসব আলুর জাত উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
পেঁয়াজ নিয়ে সুপারিশ
>> অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেট সনাক্তকরণ করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা
>> সঙ্কটকালীন সময়ে পেঁয়াজ আমদানির জন্য দ্রুত একাধিক রপ্তানিকারক দেশের সন্ধান করা।
>> অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করা।
>> কৃষি মূল্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে সারা বছর বাজারে পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ ও তদারকি করা।
>> বাজারে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ও মজুদের অগ্রিম ব্যবস্থাপনা করা।
বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও ছিলেন।
কৃষিমন্ত্রী যা বললেন
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “গত বছর বোরোর সময়ে ৩৬ টাকা দরে চাল কিনতে চেয়েছিলাম। বাজারে দাম বেশি ছিল। মূলত আগের আমনে গরিব চাষিদের কাছ থেকে ৬ লাখ টন আমন কেনা হয়েছিল। এবার এক টনও কিনতে পারিনি। ৩৬ টাকা দামে কোনো চাষি আমন দেয়নি।
“এবার আমাদের আমনের দাম ছিল ১ হাজার ৪০ টাকা মণপ্রতি। কিন্তু ময়েশ্চারের ঝামেলা এড়াতে চাষিরা ভালো দামে বাজারে চাল বিক্রি করে দিয়েছে।”
মিলার ও পাইকাররা বাজার পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে বলে স্বীকার করেন খাদ্যমন্ত্রী।
“সরকারের কাছে পর্যাপ্ত চাল না থাকায় মিলাররা সুযোগ নিয়েছে। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমরা চিন্তা করছি, আগামী বোরোতে সংগ্রহ বাড়াব। সরকারের গুদামে চাল না থাকলে কোনোভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
আমদানি উন্মুক্ত করে এর সমাধানের পথ খোঁজার কথা বলেছেন রাজ্জাক।
তিনি বলেন, “চাল আমদানির উপর ট্যাক্স কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। কিন্তু আমদানিকারকরা বলছে, আমদানিতে এ ট্যাক্সে যে দাম পড়ে, সে দামে বাজার দরের সাথে বিক্রি করলে তাদের পোষাবে না। তারা ১০ শতাংশ করার দাবি জানাচ্ছে।”
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক (ফাইল ছবি)কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক (ফাইল ছবি)
ধান উৎপাদনে নতুন জাত নিয়ে ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়ে মাঠে যাওয়ার কথা বলেন খাদ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “প্রতি বছর ২০ থেকে ২৪ লাখ নতুন মুখ আসছে। কিন্তু জমির পরিমাণ কমছে ক্রমশ। সব ফসলই তো ধানি জমিতে জায়গা করে নিচ্ছে। এর মধ্যে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে। চেষ্টা করছি উৎপাদন বাড়াতে। বর্তমানে ব্রি-২৭ ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিনা-১৬ ভালো একটা ভ্যারাইটি। বিনা-১৬ ধানটিকে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত মাঠে নিয়ে যেতে হবে।”
আলু ও পেঁয়াজের সঙ্কট নিয়েও কৃষিমন্ত্রী জানান নানা সঙ্কটের কথা।
আলু নিয়ে তিনি বলেন, “আলু উৎপাদন কম হয়েছে। চাপ পড়েছে করোনাকালে ত্রাণে আলু বিতরণ ব্যাপকভাবে করায়। তাছাড়া টিসিবির স্টোরেজেও আলু রাখার জায়গা নাই। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ লাখ টন আলু এবার উৎপাদন কম হয়েছে।”
পেঁয়াজ নিয়ে রাজ্জাক বলেন, “পেঁয়াজের নতুন জাত বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করলেও পর্যাপ্ত বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। সামার অনিয়নের জাত আসলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ উঁচু জমি নাই।”
গত ২০ অক্টোবর কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলোর সেপ্টেম্বর-২০২০ পর্যন্ত সময়ের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় এই গবেষণা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়।
ওই সভায় বলা হয়েছিল, মাঠ পর্যায়ের কৃষক, মিল মালিক, কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও স্থানীয় ভোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিএআরসির নেতৃত্বে অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি অর্থনীতিবিদরা প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করবে এবং এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন নভেম্বর মাসেই জমা দেবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় চাল, আলু ও পেঁয়াজ ইত্যাদির দাম বৃদ্ধির কারণ উদঘাটনের জন্য বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের নিয়ে গত বছরের ১২ নভেম্বর বিএআরসি কাউন্সিল মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি ‘স্টাডি টিম’ গঠন করা হয়।
গবেষণা কাজটি মূলত ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) এবং কি ইনফরমেন্ট ইন্টারভিউর (কেআইআই) মাধ্যমে প্রাথমিক ও বিভিন্ন উৎস থেকে মাধ্যমিক তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
ধান-চাল বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে নওগাঁ, শেরপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলা; আলুর ক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও ঢাকা জেলা এবং পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ফরিদপুর, পাবনা, নাটোর ও ঢাকা জেলা নির্বাচন করা হয়।
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর কাউন্সিলে আয়োজিত এক কর্মশালায় স্বতন্ত্র তিনটি খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। কর্মশালার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন মঙ্গলবার প্রকাশিত হল।