সিরাজ এখনও জামায়াত নেতা, বেরিয়ে আসছে অনেক তথ্য

Untitled-8-5cb4d7da71667

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যার পর একে একে বেরিয়ে আসছে অনেক কিছুই। অধ্যক্ষ ও প্রশাসনের অনিয়ম-দুর্নীতি, জেলার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, রাজনৈতিক নেতাদের দুর্বৃত্তায়নসহ বেশকিছু বিষয় এখন সামনে এসেছে। ফুলগাজীসহ পুরো ফেনীতে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। বাতাসে উড়ছে গুজব আর বিভ্রান্তিকর তথ্যও। নুসরাত হত্যাকে পুঁজি করে সুবিধাবাদীরাও এখন মাঠে। আগের বিরোধও সামনে আনছেন কেউ কেউ। যে যার মতো করে সুবিধা নিচ্ছেন। তবে সব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও জামায়াত নেতা সিরাজ-উদ-দৌলার অপকর্ম।

মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, অভিভাবক কমিটির সদস্য ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা জানান, আশির দশকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। পরে জামায়াতের রোকন হন। ২০১৬ সালের দিকেও তাকে জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে দেখা যেত। পরবর্তী সময়ে জামায়াতের সভা-সমাবেশে তাকে দেখা না গেলেও দলের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তবে এতকিছুর পরও জামায়াত থেকে এখনও সিরাজকে বহিস্কার করা হয়নি। এমনকি উপজেলা জামায়াতের বড় একটি অংশ এখনও তার পক্ষে কাজ করছে।

এ বিষয়ে উপজেলা জামায়াতের আমির কলিম উল্যাহ বলেন, সিরাজকে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে বহিস্কার করা হয়। জামায়াতের সঙ্গে এখন তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাকে বহিস্কারের কোনো কাগজ কিংবা প্রমাণ দেখাতে পারেননি তিনি। কলিম উল্যাহ আরও বলেন, জামায়াত কখনোই লিখিতভাবে বহিস্কারাদেশ দেয় না। মৌখিকভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জামায়াতের একটি পক্ষ এখনও সিরাজের পক্ষে কাজ করছে বলে যে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে উপজেলা জামায়াতের আমির বলেন, এটি সত্য নয়। অধ্যক্ষ জেলে যাওয়ার আগেও জামায়াতের নেতাকর্মীদের দেখলে তিনি গালি দিতেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন।

অধ্যক্ষের পক্ষে কাজ করতে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ :নুসরাতকে শ্নীলতাহানির মামলায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ যখন জেলে, তখন তার স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেন-দরবার করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফেরদৌস আক্তার এ জন্য নানা মহলকে টাকা দিয়েছেন বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে একাধিকার ফেরদৌস আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ফোনে না পেয়ে তার ফেনীর পাঠাবাড়ির বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তার বোন হোসনে আরা বেগমের মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর বাড়িতে গিয়ে তার বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি। হোসনে আরা বেগমের স্বামী সহিদুল ইসলাম বলেন, অধ্যক্ষের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার এখন কোথায় থাকেন, তারা জানেন না। সোনাগাজীর ৮নং আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরকৃষ্ণজয় গ্রামে অধ্যক্ষ সিরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার ঘরে তালা। বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে। অধ্যক্ষের স্ত্রী ও ছেলেরা এখন কোথায় আছেন, তা জানেন না সিরাজের বড় ভাইয়ের স্ত্রী হাছিনা আক্তার।

অধ্যক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধান করে দেখা যায়, তার একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে জনতা ব্যাংকের সোনাগাজী শাখায়। ওই ব্যাংকের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম বলেন, এখানে অধ্যক্ষের শুধু বেতন-ভাতার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তিনি গ্রেফতারের পর থেকে এই অ্যাকাউন্টে কোনো লেনদেন হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যক্ষের স্ত্রীর কাছে রক্ষিত টাকা তিনি প্রথমে স্বামীর মুক্তির আন্দোলন, পরে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার কাজে ব্যয় করেন। আর সিরাজের নির্দেশেই এ টাকা তিনি ব্যয় করেছেন।

আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্যে :নুসরাত হত্যার ঘটনার সঙ্গে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজনের নাম জড়িয়ে পড়ায় বিব্রত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অবস্থানে স্থানীয় নেতৃত্বের বিরোধ প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। নেতারা এখন একে অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে বিপর্যস্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়েও রয়েছে ধূম্রজাল। নেতাকর্মীরা বলছেন, জেলা কমিটি রুহুল আমিনকে সভাপতি ঘোষণা করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি। আবার আগের সভাপতি ফয়জুল কবিরকে অব্যাহতি না দেওয়ায় তিনি এখনও নিজেকে সভাপতি বলেই দাবি করেন। জেলার প্রভাবশালী নেতাদের পছন্দে পকেট কমিটি নিয়ে ইচ্ছামতো দল চালাচ্ছেন রুহুল আমিন।

নুসরাতকে যৌন হয়রানির ঘটনার পর রুহুল আমিনসহ মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত একটি পক্ষ প্রকাশ্যে ও গোপনে অধ্যক্ষ সিরাজকে রক্ষায় মাঠে নামে। অন্যপক্ষ সিরাজের বিচারের দাবিতে সক্রিয় হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আবদুল হালিম মামুন বলেন, আমরা চেয়েছিলাম নিপীড়ক অধ্যক্ষের বিচার করতে। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম আমাদের আন্দোলন করতে বাধা দিয়েছিলেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, আমি কাউকে মদদ দিইনি। আমিও চাই অপরাধীদের যেন বিচার হয়।

ম্যাজিস্ট্রেটের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে তোলাপাড় :১৯৯৬-২০০১ সালে জয়নাল হাজারীর প্রতাপের কথা ভোলেনি এই জেলার মানুষ। তারপর ২০১৪ সালে শত শত মানুষের সামনে ফেনীর একাডেমি রোডে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে এসে আবারও আলোচনায় ফেনী।

ফেনীর তৎকালীন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে। তিনি প্রকাশ করেছেন- কাদের ছত্রছায়ায় ফেনীর সন্ত্রাসীরা লালিত-পালিত হয়। সন্ত্রাসীদের মূল খুঁটিতে কারা? সন্ত্রাস থেকে দায়মুক্তি হতে সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীরও।

সোহেল রানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন। নুসরাত হত্যার পর গত ১১ এপ্রিল তিনি ফেনী জেলার মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ অপরাধী চক্র, পুলিশ প্রশাসনের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে কয়েকটি স্ট্যাটাস দেন তার ফেসবুক পেজে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘ফেনীতে এদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। আপনি খতিয়ে দেখুন, দুর্নীতিবাজ অফিসারদের নিয়ে এদের আস্টম্ফালন কী দানবাকৃতির। যদি আমি ভুল হই তবে আমাকে চাকরিচ্যুত করুন। আর যদি আমি ঠিক হই, আপনি রক্ষা করুন ফেনীকে। দয়া করে জিজ্ঞেস করুন, মাদক তালিকায় যারা শীর্ষে তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনো অভিযান নেই?’

এ বিষয়ে ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, সোহেল রানা ফেনীতে যখন ছিলেন, তখন এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করতে গিয়ে একাধিকবার তিনি হামলারও শিকার হয়েছেন। ফেনীতে অপকর্ম করতে গিয়ে বেশিদিন সুবিধা করতে না পারায় তিনি এখন এসব অপপ্রচার করছেন।
নিজাম হাজারী বলেন, অতীতের সব সময়ের চেয়ে ফেনী এখন অনেক ভালো আছে। এখানে শান্তির সুবাতাস বইছে। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ঘটনায় শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন জানিয়ে এ সাংসদ বলেন, আমার নির্দেশেই পুলিশ মামলা নিয়েছে ও অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করেছে। এ ঘটনায় আমি কাউকে প্রশ্রয় দেব না। নুসরাতের মামলা চালাতে যত খরচ লাগে সব আমি দেব। নুসরাতের নামে একটি সড়কও নামকরণ করা হবে বলে জানান তিনি। এসব বিষয়ে জানতে সোহেল রানাকে ফেসবুকে মেসেজ দিলে তিনি জবাবে বলেন, ‘আমি যে অপকর্ম করেছি তার একটা উদাহরণ এমপিকে দিতে বলুন। এমপি নিজাম হাজারী মাদক ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তার সবচেয়ে কাছের লোক জিয়াউল আলম মিস্টার। তিনি তিন তালিকাতেই ফেনীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। এমপির উদ্বোধন করা অবৈধ গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করায় তার মন খারাপ। আমার জাস্ট একটা অপকর্ম তিনি প্রমাণ করতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেব।’

কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় জাবেদ-জোবায়ের

তদন্তসংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, নুর উদ্দিন ও শাহাদাতের জবানবন্দিতে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনের নাম উঠে এসেছে। যৌন হয়রানি মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেফতার হওয়ার পর তারই নির্দেশে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামে। নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়ার পর মোবাইল ফোনে রুহুল আমিনকে প্রথম জানিয়েছিল শাহাদাত। দু’জনের মধ্যে মাত্র ছয় সেকেন্ড কথা হয়েছিল। নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফেনীর কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, নুর উদ্দিন ও শাহাদাত আগুন দেওয়ার দায় স্বীকার করেছে। হত্যাকাণ্ডে কারা কীভাবে পরিকল্পনা করেছে, সরাসরি হত্যায় অংশ নিয়েছে কতজন এবং কোথা থেকে নির্দেশ এসেছে, তাও বর্ণনা করেছে। এর আলোকে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, প্রথমে নুসরাত হত্যায় সরাসরি চারজনের অংশ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে স্বীকারোক্তিতে তারা বলেছে, ছাদে আগে থেকেই এক তরুণীসহ চারজন অবস্থান নিয়েছিল এবং পরে যোগ দেয় উম্মে সুলতানা পপি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পপিই নুসরাতকে বলেছিল, তোমার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এ খবরে নুসরাত ছাদে যান এবং পপিও তার পিছে পিছে যায়। সেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগুন দেওয়ার সময় কৌশলের অংশ হিসেবে অন্যরা শম্পা বলে ডাকে পপিকে।

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে যান নুসরাত। তিনি এই মাদ্রাসার এবারের আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে ২৭ মার্চ মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন নুসরাত। এ ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। মামলা তুলে নিতে আসামিপক্ষ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নুসরাত। এর জের ধরেই তাকে ডেকে নিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ৮০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন লড়ার পর মারা যান নুসরাত।

নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই। এ পর্যন্ত অধ্যক্ষ সিরাজ, মাদ্রাসাছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত, জোবায়ের আহম্মেদ, জাবেদ হোসেন, মাদ্রাসাছাত্রী উম্মে সুলতানা পপি এবং সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলমসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত রোববার রাতে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। রাত ১টা পর্যন্ত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। পরে আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের কাছে রিমান্ডে থাকা নুর উদ্দিন ও শাহাদাতকে ফেনীর আদালতে হাজির করা হয়। পিবিআইর পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম প্রয়োজনীয় কাজপত্র সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকির হোসেনের আদালতে দাখিল করেন।

আদালত সূত্র জানায়, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আইনের বিধান অনুসারে আসামিদের জানিয়ে দেন, স্বীকারোক্তি দেওয়া হলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হবে। তিনি আসামিদের একাকী ভাবার জন্য ৩ ঘণ্টা সময় দেন। প্রথমে নুর উদ্দিন ও পরে শাহাদাত জবানবন্দি দেয়। তারা নুসরাত হত্যায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।

আসামিদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষে রোববার রাত সোয়া ১টার দিকে পিবিআইর স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহেরুল হক চৌহান আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, নুর উদ্দিন ও শাহাদাত ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। নুসরাত হত্যায় কার কী ভূমিকা ছিল তার পুরোটাই বর্ণনা করেছে তারা। জড়িতদের নাম-পরিচয়ও বলেছে। তাহেরুল হক চৌহান জানান, এখন পর্যন্ত পিবিআই ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। আরও কিছু নাম পুলিশ পেয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করছি না। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে বাকিদেরও গ্রেফতার করা হবে।

নুর উদ্দিন ও শাহাদাত আদালতকে জানায়, ২৭ মার্চ নুসরাত অধ্যক্ষ সিরাজের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর দায়ে সিরাজ গ্রেফতার হওয়ার পর তার মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে অর্থের জোগান দেওয়া ব্যক্তি ও নেপথ্যে থাকা সিরাজের সমর্থকদের নামও জানিয়েছে তারা। সিরাজের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে তারা ৫ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে মাদ্রাসার একটি হোস্টেলে। হত্যা মিশনের স্থান হিসেবে তারা বেছে নেয় মাদ্রাসা চত্বরে সাইক্লোন শেল্টার ভবনের তিন তলার ছাদকে। কারণ নিরিবিলি স্থান সেটি। ছাদে চিৎকার করলেও বাইরে থেকে শোনার উপায় নেই। ওই ছাদে রয়েছে মেয়েদের টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা। তবে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে ওই ভবনের ছাদে কেউ থাকবে না বলে তারা একমত হয়। কিলিং মিশন শেষে পালানোর রাস্তাও ঠিক করে রাখে তারা।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে আন্দোলন করতে ও নুসরাতের শরীরে ছদ্মবেশে আগুন দিতে বোরকা কেনার জন্য সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম নুর উদ্দিন ও শাহাদাতকে ১০ হাজার টাকা দেন। মাদ্রাসার এক শিক্ষক দেন পাঁচ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা নেয় নুর উদ্দিন। তিনটি বোরকা কেনার জন্য শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে কামরুন নাহার মণিকে দেওয়া হয় দুই হাজার টাকা। ৬ এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে শাহাদাত সোনাগাজী বাজারে যায়। তখন ওই মেয়ে তাকে দুটি নতুন ও একটি পুরনো বোরকা দিয়ে যায়। শাহাদাত পলিথিনে করে এক লিটার কেরোসিন কেনে।

নুর উদ্দিন ও শাহাদাত আদালতে স্বীকার করেছে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ এপ্রিল সকাল সোয়া ৯টার দিকে শাহাদাত, জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ও কামরুন নাহার মণি বোরকা পরে ছাদে অবস্থান নেয়। উম্মে সুলতানা পপি অবস্থান নেয় মাদ্রাসা চত্বরে। পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট আগে নুসরাতকে পপি জানায়, ছাদে নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে। নুসরাতের ওপর যৌন নির্যাতনের সাক্ষী ছিল নিশাত। এ খবর শুনে নুসরাত ছুটে যান ছাদে। পপিও তার পেছনে ছাদে উঠে আসে। ছাদে নিশাতকে খোঁজাখুঁজি করেন নুসরাত। না পেয়ে ছাদে দাঁড়ান। এ সময় উম্মে সুলতানা পপি এবং ছাদে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া অন্যরা নুসরাতকে ঘিরে ধরে। তাকে মামলা তুলে নিতে বলে পপি। এরপর শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে মণিও একই কথা বলে নুসরাতকে। নুসরাত জবাবে বলেছিলেন, তিনি মামলা তুলবেন না। তার গায়ে অধ্যক্ষ কেন হাত দিয়েছিল। ওস্তাদ তো ওস্তাদ। তিনি এর শেষ দেখেই ছাড়বেন বলে তাদের জানিয়েছিলেন। তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে শাহাদাত জানিয়েছে, মামলা তুলতে রাজি না হওয়ায় সে পেছন থেকে এক হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং অপর হাত দিয়ে একটি হাত ধরে। শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়ে শরীর চেপে ধরে। পপি ধরে নুসরাতের পা। এরপরই তারা নুসরাতকে ছাদে চিত করে শুইয়ে ফেলে। এ সময় কৌশলে উম্মে সুলতানা পপিকে তারা শম্পা বলে ডাক দেয়। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করেন নুসরাত। চিৎকারও করেন তিনি। নুসরাতের ওড়না দুই টুকরো করে তার হাত ও পা বেঁধে ফেলে জোবায়ের। এরপরই জাবেদ তার গলা থেকে পা পর্যন্ত এক লিটার কেরোসিন ঢেলে দেয়। পলিথিনে করে এই কেরোসিন আনা হয়েছিল। এরপর দেশলাই বের করে কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় নুসরাতের পায়ের দিকে। তার শরীরে আগুন জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে ওই পাঁচজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। নামার সময় শাহাদাত, জোবায়ের ও জাবেদ বোরকা খুলে ফেলে। পপিসহ দুই তরুণী মাদ্রাসায়ই তাদের পরীক্ষার কক্ষে চলে যায়। তারা নামার সময়ও নুসরাতের আর্তনাদ শুনতে পায় তারা। তার পা ও হাতের বাঁধন আগুনে পুড়ে খুলে যায়। নুসরাতের মুখ শাহাদাত চেপে ধরে থাকায় সেখানে কেরোসিন ঢালা হয়নি। তাই পুরো শরীর পুড়লেও মুখে আগুন লাগেনি। আগুন দেওয়ার আগে তারা প্রত্যেকে হাতে-পায়ে মোজা লাগিয়ে নিয়েছিল।

শাহাদাত উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে পালায়। বাইরে গিয়ে সে রুহুল আমিনকে ফোন করে আগুন দেওয়ার বিষয়টি জানায়। সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি মামলার ঘটনায় রুহুল আমিন থানা ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

জবানবন্দিতে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত পৃথকভাবে নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। নুসরাতকে ২০১৭ সালে প্রেমের প্রস্তাব দেয় নুর উদ্দিন। প্রত্যাখ্যান করায় সে সময় মাদ্রাসা থেকে বাসায় ফেরার পথে নুসরাতের চোখেমুখে চুন ছুড়ে মারে সে। শাহাদাতও প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল নুসরাতকে। তার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে নুসরাত। এ কারণে তারা দু’জনই নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল।

পিবিআইর পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম জানান, নূর উদ্দিন ও শাহাদাতের বক্তব্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সিরাজের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ও নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়ার পর যারা ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে ও ঘটনা ধামাচাপা দিতে অর্থের জোগান দেয়, তাদের নাম-ঠিকানা পিবিআইর হাতে রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

কাউন্সিলর মাকসুদ পাঁচ দিনের রিমান্ডে :নুসরাত হত্যা মামলার অন্যতম আসামি পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার সকালে মাকসুদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত পাঁচ দিন মঞ্জুর করেন।

Pin It