১৯১১ সালের ২০ জুন (১০ আষাঢ়, ১৩২৮) বরিশালের শায়েস্তাবাদ নবাব পরিবারে সুফিয়া কামালের জন্ম। ডাক নাম ছিল হাসনা বানু। নানী রেখেছিলেন এই নামটি আরব্য উপন্যাসের হাতেম তাইয়ের কাহিনি শুনে। সুফিয়া খাতুন নামটি রেখেছিল দরবেশ নানা। তিনিই–সুফিয়া কামাল। ‘একালে আমাদের কাল’ শীর্ষক লেখায় সুফিয়া কামাল তার জন্ম প্রসঙ্গে বলেছেন এভাবে:
‘মাটিকে বাদ দিয়ে ফুল গাছের যেমন কোন অস্তিত্ব নেই আমার মাকে বাদ দিয়ে আমারও তেমন কোন কথা নেই। আমি জন্ম নেবার আগেই মায়ের মুখে ‘হাতেম তাইয়ের কেচ্ছা’ শুনে আমার নানীআম্মা আমার নাম রেখেছিলেন হাসনা বানু। আমার নানা প্রথম বয়সে সদর আলা থেকে জজগিরি পর্যন্ত সারা করে শেষ বয়সে সাধক–‘দরবেশ’ নাম অর্জন করেছিলেন। শুনেছি যে-দিন আমি হলাম, নিজের হাতে আমার মুখে মধু দিয়ে তিনি আমার নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন। কিন্তু আমার ডাক নাম হাসনা বানুটাই আমাদের পরিবারে প্রচলিত। সুফিয়া বললে এখনও কেউ কেউ আমাকে হঠাৎ চিনতে পারেন না। আমার ভাইয়া ছোট বেলায় আমাকে ডাকতেন ‘হাচুবানু’ বলে; কেউ কেউ বলতো ‘হাসুবানু’।’
তার পিতা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন উকিল। সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন তার পিতা গৃহত্যাগ করেন। নিরুদ্দেশ পিতার অনুপস্থিতিতে তিনি মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের পরিচর্যায় লালিত-পালিত হতে থাকেন। শায়েস্তাগঞ্জে নানার বাড়ির রক্ষণশীল অভিজাত পরিবেশে বড় হয়েও সুফিয়া কামালের মনোগঠনে দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজ এবং ভাষা ও সংস্কৃতি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সুফিয়া কামাল নিজেও ‘একালে আমাদের কাল’ লেখায় উল্লেখ করেন–‘আমরা জন্মেছিলাম এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কালে। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞান জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা, এসবের শুরু থেকে যে অভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ আমাদের মনে ছাপ রেখেছে সুগভীর ভাবে।’
সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজেই বাংলা ভাষা শিখে নেন। পর্দার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন একজন আধুনিক মানুষ।
১৯২৩ সালে মাত্র বারো বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়। তখন তিনি ‘সুফিয়া এন. হোসেন’ নামে পরিচিত হন। নেহাল হোসেন ছিলেন একজন উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি সুফিয়াকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। সাহিত্য ও সমসাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। এর ফলে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ধীরে ধীরে তিনি একটি সচেতন মনের অধিকারিণী হয়ে ওঠেন। তার পক্ষে সম্ভব হয় পশ্চাৎপদ মহিলাদের মধ্যে গিয়ে সেবামূলক কাজ করা। ১৯২৩ সালে তিনি রচনা করেন তার প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধু’ যা বরিশালের ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মহাত্মা গান্ধীর হাতে তুলে দেন নিজ হাতে চরকায় কাটা সূতা (১৯২৫)। কলকাতায় গেলেন। সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হলো প্রথম কবিতা বাসন্তী (১৯২৬)। সামাজিক, পারিবারিক বাধা ভেঙ্গে বাঙালি পাইলটচালিত বিমানে চড়লেন (১৯২৮)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন প্রমুখের প্রভাব ও সহযোগিতায় তার জীবন বিকশিত হয়েছে কৈশোর থেকে তারুণ্যে।
বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কবি তারুণ্য পেরিয়েছেন। ২১ বছর বয়সে নেহাল হোসেনকে হারালেন (১৯৩২), বেগম রোকেয়াকে হারালেন (১৯৩২)। পারিবারিক অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব তাকে নিঃশেষ করতে পারেনি। তিনি মেরুদণ্ড সোজা করে জয় করেছেন মানবসত্বা। অনেকেই তাকে সহযোগিতা করেছেন। সর্বাগ্রে বলতে হয় কামালউদ্দিন খানের নাম, যিনি ১৯৩৯-এ সুফিয়া কামালের করকমল হাতে তুলে নিয়ে ৩৮ বছর সুফিয়া কামালের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী হয়েছিলেন। মাকে হারালেন ১৯৪১-এ। পুত্র শোয়েবকে হারালেন ১৯৬৩-তে। স্বামী কামালউদ্দিন খানকে হারালেন ১৯৭৭-এ।
সুফিয়া কামাল সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সমাজসেবা ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকাণ্ডে বিশেষ ভাবে যুক্ত ছিলেন, তার ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়– ‘চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথমে সমাজ সেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তার সঙ্গে দুঃস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।’
জীবনের পরবর্তী সময়ে সমাজসেবা ও সংগঠনমূলক কাজের বিবরণ সুফিয়া কামাল এভাবে বর্ণনা করেন– ‘প্রথম জীবনে কাজ করার পর আঠার থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ‘আঞ্জুমান মাওয়াতিনে’ কাজ করি। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল কলকাতার বস্তি এলাকার মুসলমান মেয়েদের মনোভাবে একটু শিক্ষিত করে তোলা। মিসেস হামিদা মোমেন, মিসেস শামসুন্নাহার মাহমুদ, সরলা রায়, জগদীশ বাবুর স্ত্রী অবলা বসু, ব্রহ্মকুমারী দেবী এরা সকলেই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। আমার স্বামী ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ, এসব কাজে তার কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি আমি। এর পর ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্ধমানে এবং ‘৪৬ এর ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’র হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বিপন্ন এবং আহতদের মধ্যে কাজ করেছি। এই সময়ই তো হাজেরা মাহমুদ, রোকেয়া কবীর, হোসনা রশীদ ও তোমার (নূরজাহান মুরশিদ) সঙ্গে আমার পরিচয় হল। ১৯৪৭ এর পরই ঢাকায় এলাম। প্রথমে ওয়ারি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত করি এবং এই সমিতির মাধ্যমেই কাজ শুরু করি। প্রখ্যাত নেত্রী লীলা রায় আমাকে সমাজ কল্যাণের কাজে এগিয়ে আসতে আহবান জানান। এরপর পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আমি বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ি।’
১৯৩১ সালে সুফিয়া মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৩-৪১ পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই স্কুলেই তার পরিচয় হয় প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) এবং কবি জসীম উদ্দীন (১৯৩৩-১৯৭৬) এর সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে সুফিয়া ব্যাপকভাবে সমাজসেবা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন। এ বছরই তাকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে তার যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সুলতানা পত্রিকা, যার নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থের প্রধান চরিত্রের নামানুসারে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমন-নীতির অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ (বর্তমানে-বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) গঠিত হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা–প্রধান নির্বাচিত হন এবং আজীবন তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পরও সুফিয়া কামাল অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি যে সব সংগঠনের প্রতিষ্ঠা-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন সেগুলি হলো: বাংলাদেশ মহিলা পুনবার্সন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুঃস্থ পুনর্বাসন সংস্থা। এছাড়াও তিনি ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থটি। এর ভূমিকা লিখেছিলেন নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ এটি পড়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে সুফিয়া এন. হোসেন (তার তখনকার পরিচয়)কে লেখেন, ‘তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা।’ শুধু সাহিত্যে নয়, বাংলাদেশের জনগণের মনে বেগম সুফিয়া কামাল ধ্রুব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তার স্বকীয় স্বভাবগুণে।
সুফিয়া কামাল ‘একালে আমাদের কাল’ নামে একটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন। তাতে তার ছোটবেলার কথা এবং রোকেয়া-প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। তিনি অনেক ছোটগল্প এবং ক্ষুদ্র উপন্যাসও রচনা করেছেন। কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) তার একটি উল্লেখযোগ্য গল্প গ্রন্থ। তার আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), উত্তপ্ত পৃথিবী (১৯৬৪), অভিযাত্রিক (১৯৬৯) ইত্যাদি। তার কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে রুশ ভাষায় তার সাঁঝের মায়া গ্রন্থটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও তার বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি তার কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ দিয়ে Mother of Pears and other poem এবং ২০০২ সালে সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছে।
কেয়ার কাঁটা সমেত সুফিয়া কামালের মোট প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ সংখ্যা চার। অন্য তিনটি হলো– সোভিয়েটের দিনগুলি (ভ্রমণ, ১৯৬৮), একালে আমাদের কাল (আত্মজীবনীমূলক রচনা, ১৯৮৮) এবং একাত্তরের ডায়েরী (১৯৮৯)। অগ্রন্থিত গদ্যের মধ্যে রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস অন্তরা। বৈশাখ ১৩৪৫ থেকে পাঁচ কিস্তিতে অন্তরা প্রকাশিত হয় কলকাতার মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। এর পরে আছে আর একটি ছোট্ট উপন্যাস (Novella) জনক। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রিমিয়ায় স্বাস্থ্য নিবাসে ১৯৭৭ সালে ৬ থেকে ২০ জানুয়ারির মধ্যে মাত্র ১৫ দিনে সুফিয়া কামাল জনক রচনা করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত নূরজাহান বেগম সম্পাদিত সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ১২ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় (৩০ বর্ষ ৩৭ থেকে ৪৮ সংখ্যা, ১৯ মার্চ, ১৯৭৬ থেকে ৪ জুন, ১৯৭৮)। উপন্যাস দু’টি সংগ্রহের কাজ চলছে।
সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ নামক জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন; কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি পুরস্কার ও পদক হলো: বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), Women’s Federation for World Peace Crest (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) ইত্যাদি। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের Lenin Centenary Jubilee Medel (১৯৭০) এবং Czechoslovakia Medal (১৯৮৬)সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামালের জীবনাবসান ঘটে।
২. তার দৃষ্টিভঙ্গি ও কিছু মন্তব্য
সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত কিন্তু গদ্যলেখক হিসেবেও তার অবদান রয়েছে। বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে তার ভূমিকা ছিল বিশেষ ভাবে উজ্জ্বল। তার সময়কালে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের একজন মহিলা হিসেবে সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে ভূমিকা রাখা ছিল শুধু গৌরবের নয়, বিশেষ ভাবে অসাধারণ বিষয়। সুফিয়া কামাল এক সাক্ষাৎকারে তার বেড়ে ওঠা সময়কালের সামাজিক অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেন– ‘তখনকার সময়টাতে শ্রেণীভেদ একটা বড়ো ব্যাপার ছিল। বড়োলোক, ছোটলোক, সম্ভ্রান্ত লোক, চাষী-কৃষক, কামার-কুমার ইত্যাদি সমাজে বিভিন্ন ধরনের বংশ ছিল এবং এইসব বংশে শ্রেণীবিভেদ ছিল। সেই শ্রেণীভেদ অনুসারে বলা যায়, তখন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের ঘরের মেয়েরা পড়ালেখা বেশি জানতো না। তারা বড়োজোর কুরআন শরিফ পড়া শিখতো। আর হয়তো বাবা-মায়ের কাছে দোয়া-দরুদ নামাজ পড়া শিখতো। এই ছিল তাদের শিক্ষা। স্কুল-কলেজের বালাই তো ছিলই না। তবে ধর্মীয় শাসনের একটি প্রক্রিয়া ছিল। সেটা ছেলে-মেয়ে সকলের ওপরই কার্যকর থাকতো।’ (আহমদ কবির, সুফিয়া কামাল, বাংলা পিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ২২২)।
সুফিয়া কামাল পর্দাযুগের মেয়েদের সঙ্গে এখনকার সময়কালের মেয়েদের তুলনা করেন এভাবে, যাতে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনা লক্ষ করা যায়–‘আগে মেয়েরা ষোলআনা নির্ভরশীল ছিল পুরুষের ওপর। স্ত্রীকন্যার কি প্রয়োজন না প্রয়োজন তা স্বামী বা পিতাই নির্ধারণ করতেন। যেখানে পুরুষ মানুষটি এসব ব্যাপার তেমন মাথা ঘামাতো না সেখানে স্ত্রীকন্যা নীরবে কষ্ট সহ্য করতো এবং সেই পরিস্থিতিতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতো। এখন আবার যে সব মেয়েদের রোজগার আছে- স্বামীরা তাদের রোজগার কেমন করে খরচ হবে তাও বলে দিতে চায়। আর টাকা পয়সার ব্যাপারে দেখা গেছে মেয়েরা নিজের টাকা যত খরচ করে স্বামীরা ততই হাত গুটোয়। পুরুষদের সম্পর্কে উক্তি আছে ‘তারা হাতে মারে, ভাতে মারে, দাঁতে মারে’ এই অবস্থায় একজন মানুষ সুখী কেমন করে হবে? আর মেয়েদের ক্ষেত্রে কত স্তরের দুঃখ যে আছে তার ঠিক নেই। তাই তুলনামূলকভাবে কাউকে কাউকে একটু বেশী সুখী মনে হয়। পর্দার যুগে কোন অবস্থাতেই মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারতো না- আজকাল পারে। মেয়েদের স্বামী পরিত্যাগ করার ঘটনাও বিরল নয়। আজকাল মেয়েদের স্বাধীনতা বেশী এবং সেই অনুপাতে নিশ্চয়ই সুখও বেশী।’ (কুররাতুল আইন তাহমিনা, শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল, অবসর (৪২), ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২০ জুন ১৯৯৮, পৃ. ৫)।
সুফিয়া কামাল নারীর সামাজিক শৃংখল ভেঙে মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করার জন্য নিবেদিত ছিলেন। নারীর সামগ্রীক মুক্তির জন্য তার ভূমিকা ছিল সমসময়ের জন্য উদ্দীপনামূলক ও আগ্রহউদ্দীপক, সে কারণে তার অনুভব এমন–‘আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে এই দেখে যে, মেয়েরা আগের তুলনায় এখন অনেক সাহসী হয়েছে। মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরিয়ে অন্তত নিজেদের কথা বলতে শিখেছে। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়েরা কথা বলতে শিখুক, সাহসী হয়ে উঠুক, নিজেদের অধিকার তারা বুঝতে পারুক। এটা এখন হয়েছে। এটা বড়ো আনন্দের।’ ( নূরজাহান মুরশিদ, বেগম সুফিয়া কামালের মুখোমুখি, একাল, ঢাকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৮৬, পৃ. ৩৫)।
তবে নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে সুফিয়া কামালের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধগত বিবেচনা ছিল, এ কারণে তিনি নারী স্বাধীনতার সাথে সাথে নীতি-আদর্শ-ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন, এমনি প্রতিভাস তার বক্তব্য থেকে জানা যায়–‘মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই সেই স্বাধীনতার ব্যবহার সব সময় সঠিকভাবে করতে শেখেনি। অনেক সময় অপব্যবহার করছে। এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। এই যে মেয়েরা অপ্রয়োজনে বিদেশের ফ্যাশনের হুজুগে নিজেদের সংস্কৃতি বিরোধী কাপড় পরছে, ব্যবসায়ী মহল তাদেরকে ব্যবহার করছে নানাভাবে, মেয়েরা ভাবছে এটাই স্বাধীনতা। এটাই অপব্যবহার। মেয়েরা মডেলিং করুক, অভিনয় করুক, কিন্তু তা যেন মর্যাদা হারাবার মাধ্যম না হয়। অযথা অশালীন অভিনয়, যাত্রা, নাচগানের কোনো দরকার নেই। নারীদের যেন কোনো পণ্য না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিজ্ঞাপনে মেয়েদের শরীর প্রদর্শন করিয়ে কোটি কোটি টাকা অর্জন করা হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। পর্ণো ম্যাগাজিনের পণ্য হওয়া মেয়েদের বন্ধ করতে হবে।’ (কুররাতুল আইন তাহমিনা, শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল, অবসর (৪২), ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২০ জুন ১৯৯৮, পৃ. ৮)।
সুফিয়া কামাল রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কথা ভেবেছেন, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার বাসনা অনুভব করেছেন। মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও সাম্য তার লেখা ও কর্মকাণ্ডে ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করেছে। দার্শনিক বিবেচনাবোধ থেকে এভাবে তিনি ইতিহাস ও সমাজ বিশ্লেষণ করেছেন– ‘ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে, মূঢ়তা এবং হিংস্রতা যখন সীমা অতিক্রম করেছে তখনই তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে- সে নিজেকেই নিজে ধ্বংস করেছে। হয়তো অনেক সুন্দর ও শুভকে এজন্যে আত্মহুতি দিতে হয়, কিন্তু ভয় এবং হতাশায় নিস্কৃতি কোথায়?——- আরও একটা কথা মানি, আমাদের দারিদ্র্য এবং হতাশার অন্যতম কারণ; জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের সম্পদের অভাব; মানুষের ক্ষুধায় এবং লোভে প্রকৃতি লুন্ঠিত, শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিকারের পথ একটাই : দুঃখের অন্ন সবাইকে একসাথে ভাগ করতে খেতে হবে, তারপর মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাই সব সমস্যা দূর করতে সক্ষম।’ (কুররাতুল আইন তাহমিনা, শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল, অবসর (৪২), ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২০ জুন ১৯৯৮, পৃ. ৮)।
‘তার ব্রত মানুষের কল্যাণ। তার ছিল সত্যের সাধনা। কঠিন দুঃকীর্ণ সত্যের। সততার সাধনায় মেলে সাহস, অর্জিত হয় চারিত্রিক দৃঢ়তা। তার ব্যক্তিত্বের শিরদাঁড়া এই চরিত্র- ঋজু ব্যক্তিত্ব, দৃঢ় চরিত্র আর স্বচ্ছ মানস জন্ম দেয় সুন্দরের। যে সুন্দর সাহসী এবং ওজস্বী। আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদায় পরিপক্ক। সুফিয়া কামাল সংসারকে কখনও প্রাধান্য পেতে দেননি, এমনকি কাব্যকেও জীবন জুড়ে দাঁড়াতে দেননি, খ্যাতি বা প্রতিষ্টা গ্রাস করতে পারেনি জীবন। তার পটভূমি ও ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল দেশ ও ইতিহাস। দেশের কাজ এবং ইতিহাসের দায় সুফিয়া কামালকে সবসময়ে রেখেছে ব্যস্ত। কঠিন এবং অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে বারংবার। ইতিহাসের কী সব ঘূর্ণিপাক, বাঁক তিনি পেরিয়েছেন সাবলীল স্বচ্ছতায় যখন বহু মণিষীও হোঁচট খেয়েছেন, বোকা হয়েছেন। এভাবে সুফিয়া কামাল যেন হয়ে উঠেছিলেন সত্য পথের ধ্রুবতারা। প্রজ্ঞার মাধুর্যে স্থির আর চিত্তের জৌলুসে উজ্জ্বল।’ ( নূরজাহান মুরশিদ, বেগম সুফিয়া কামালের মুখোমুখি, একাল, ঢাকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৮৬, পৃ. ৩৫)
‘আমরা তাকে বলি জননী সাহসিকা। এই জননী-প্রতিমা জাতি, ধর্ম-বর্ণ অতিক্রম করে তার স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক কল্যাণময়তায় সবাইকে নাড়া দেয়। সেখানে ছেলেমেয়ের বৈষম্যও থাকে না। জননীত্ব স্বয়ং সার্বভৌমত্ব পায়। তা শুধু আগলেই রাখে না, বাড়তেও দেয়। জীবনের শোভন সুন্দর বিকাশের মানসিক আশ্রয় হয়ে থাকে। ব্যাপ্ত চরাচরে প্রকৃতি যেমন তেমনই। একই রকম স্বয়ংক্রিয় সুষমা। একই রকম প্রত্যয়দৃঢ় আত্মগরিমা। অহংকারের আস্ফালন নেই, কিন্তু সংকোচ বা আপসও নেই। মৃদু মাধুর্যে অন্তরাত্মার সত্য ছবি আঁকে। মুক্ত প্রাণের অবাধ মহিমাকে অকুণ্ঠে ফুটিয়ে তোলে। শুধু নিজের ভেতরে নয়। জাগিয়ে তোলে তা আর সবার ভেতরেও। তাই শুধু জননী নন, তিনি জননী সাহসিকা। প্রকৃতি যে নারীত্বের সমার্থক, তারই প্রাণশক্তিকে পরিপূর্ণ ধারণ করে তার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটান তিনি আপন জীবন ধারায়। কোন অশুভ বাধাই তিনি মানেন না কায়েমি স্বার্থের পিছুটানকেও স্বীকার করেন না। ‘সর্ব খর্ব তারে দহে’ সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রকৃতির সহজতায় নিজেকে মিলিয়ে জননীর অনপেক্ষ সমদৃষ্টি নিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যে মঙ্গল দীপ জ্বেলে সবার্ত্বক শুভকামনা নিয়ে সামনে থেকে পথ দেখিয়ে তিনি এগিয়ে চলেন। অন্যায়ের সুস্পষ্ট প্রতিবাদ তাতে মেশে। মেশে দুঃশাসনের প্রতিরোধ। নারী তার পূর্ণতায় পরমা হয় বুঝি এভাবেই। অখ- মনুষ্যত্বের চরিতার্থও তার এখানেই।’ (আবুল মোমেন, সত্যপথের ধ্রুবতারা, শুক্রবারের সাময়িকী, প্রথম আলো, ঢাকা, ২৬ নভেম্বর ১৯৯৯, পৃ. ১৪)।
‘তার অনুভূতি, মনন, বুদ্ধি, ইচ্ছা, এমন কি কায়া, ছিল সমস্ত পৃথিবীর সাথে তিনি যে একাত্ববোধ নিয়ে চলতেন তারই এক অবিচ্ছেদ্য রূপ। তিনি সর্বদাই পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন- হয়ত গড়ার কাজে নয়ত প্রতিবাদে। এ উপস্থিতিতে তিনি সদা নির্দেশ নিয়েছেন তার বিবেকের কাছ থেকে এবং কখনওই হননি পলায়নপর।’ (সনৎকুমার সাহা, রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর সম-অংশীদারিত্ব: রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সংবাদ সাময়িকী, সংবাদ, ঢাকা ২৪ জুন ২০০৪ পৃ. ১৩)।
কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক