পেট্রোল পাম্পে সারারাত ডিউটি করে সকাল ৯টায় বাসায় ফেরেন আবদুস সোবহান ওরফে সুমন মিয়া। এসে দেখেন দরজা ভেতর থেকে খোলা। দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখেন, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। মেঝেতে পড়ে আছে প্রিয় দুই শিশুকন্যা ও স্ত্রীর রক্তাক্ত নিথর দেহ। পাশেই আহত অবস্থায় বসে কাঁদছে বড় ভায়রা আব্বাসের প্রতিবন্ধী মেয়ে সুমাইয়া আক্তার। এ দৃশ্য দেখে সুমন চিৎকার করে ওঠেন। পরক্ষণেই নির্বাক হয়ে বসে পড়েন স্ত্রী-সন্তানদের লাশের পাশে। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে বীভৎস এ ঘটনা দেখে তারাও থ বনে যান। এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে আহত সুমাইয়াকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে নাসিকের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সিআই খোলা এলাকার আনোয়ার হোসেনের বাড়ির ষষ্ঠতলার একটি ফ্ল্যাটে। নিহতরা হলো- গৃহবধূ নাজনীন আক্তার (২৭), তার মেয়ে নুসরাত জাহান নিঝু (৬) ও খাদিজা আক্তার (২)। রক্তাক্ত আহত অবস্থায় নিহত নাজনীনের বড় বোনের প্রতিবন্ধী কিশোরী মেয়ে সুমাইয়া আক্তারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি ছোরা উদ্ধার করেছে।
পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক আনোয়ার হোসেন, কেয়ারটেকার কবীর হোসেন ও নিহত নাজনীনের বড় বোন ইয়াছমিন আক্তারকে আটক করেছে। তবে ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে নিহত নাজনীনের বড় বোন ইয়াছমিনের স্বামী আব্বাসকে। বিকেলে আব্বাসকে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এলাকায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। আব্বাস পেশায় খানসামা (ওয়েটার)।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পারিবারিক কলহের জেরে এই পরিবারেরই কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি নিহত নাজনীনের বড় বোনের স্বামী আব্বাস একাই তিনজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে। আব্বাসের প্রতিবন্ধী মেয়ে সুমাইয়া ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সুমাইয়া বিষয়টি পুলিশকে নিশ্চিত করেছে।
সকালে ঘটনাস্থল সিদ্ধিরগঞ্জের সিআই খোলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে আনোয়ার হোসেনের বাড়ি ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। ওই বাড়ির আশপাশের বাড়ির ছাদেও নারী-পুরুষের জটলা। সবার দৃষ্টি আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে। খবর পেয়ে সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা দুপুরে আলামত সংগ্রহ করার পর লাশ নারায়ণগঞ্জ দেড়শ’ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
নিহত নাজনীনের স্বামী সুমন বলেন, তিনি সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় জোনাকী পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন। বুধবার তার নাইট ডিউটি ছিল। সকাল ৯টায় তিনি বাসায় ফিরে মর্মান্তিক এ দৃশ্য দেখতে পান। দেখেন ফ্ল্যাটের দরজা খোলা তবে ভেড়ানো। তিনি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই বড় একটি ধাক্কা খান। মেঝেতে স্ত্রী ও দুই মেয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশেই বড় ভায়রা আব্বাসের মেয়ে সুমাইয়া বসে কাঁদছিল। রক্তে পুরো মেঝে ভরে গেছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি চিৎকার করে ওঠেন। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। ওই সময় তিনি কী করবেন বুঝতে না পেরে স্ত্রী-সন্তানদের লাশের পাশে বসে পড়েন। কোনোমতে আহত সুমাইয়াকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, তারা বাবাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বাবা তাকেও মারার জন্য ছুরি দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। সুমাইয়ার বরাত দিয়ে সুমন আরও জানান, সকাল ৮টার দিকে আব্বাস তার ফ্ল্যাটে আসে। ওই সময় বড় বোন ইয়াছমিনকে মারধর করা নিয়ে আব্বাসের সঙ্গে নাজনীনের বাদানুবাদ হয়।
সুমন বলেন, তার বড় ভায়রা আব্বাসের সঙ্গে জ্যাঠাস ইয়াছমিনের পারিবারিক কলহ চলছিল। গত মঙ্গলবারও দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়। ওই সময় আব্বাস তার জেঠাস ইয়াছমিনকে মারধর করেন। এ খবর পেয়ে শ্যালক হাসান আব্বাসের বাসায় গিয়ে তাকে মারধর করেন। পারিবারিক কলহের কারণে বুধবার রাতে মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে ইয়াছমিন আমাদের বাসায় চলে আসে। বড় বোন ইয়াছমিনকে মারধরের কারণে একবার নাজনীন দুলাভাই আব্বাসকে চড় দিয়েছিলেন বলে জানান সুমন।
এদিকে নিহতের বড় বোন ইয়াছমিন বলেন, তিনি আদমজী ইপিজেডে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের কারণে তিনি বুধবার রাতে মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে ছোট বোন নাজনীনের বাসায় চলে আসেন। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি কাজে চলে যান। পরে গার্মেন্টে কর্মরত অবস্থাতেই জানতে পারেন ছোট বোন নাজনীন খুন হয়েছেন। এ খবর পেয়ে তিনি নাজনীনের বাড়িতে ছুটে আসেন। তিনি আরও বলেন, তিনি নাজনীনের পাশের মহল্লা বাতানপাড়া এলাকায় স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ভাড়া থাকেন। তার স্বামী মাদকাসক্ত। এ কারণে প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো।
নিহত নাজনীনের শ্বশুর নিজাম উদ্দিন বলেন, সকাল ১০টায় ছেলে সুমন তাকে ফোন করে বলে, বাবা আমার সব শেষ। নিঝু-খাদিজাসহ তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ খবর পেয়ে আমরা সুমিলপাড়ার বাসা থেকে দ্রুত সিআই খোলা চলে আসি।
তিনি বলেন, আমার জানা মতে আমার ছেলের কোনো শত্রু নেই। তাহলে কে এ ঘটনা ঘটাল। প্রেম করে নাজনীনকে বিয়ে করায় আমরা ওই বিয়ে মেনে নিইনি। তাই সুমন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সিআই খোলা এলাকায় ভাড়া থাকত।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি কামরুল ফারুক বলেন, পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে পৌনে ৯টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনা ঘটেছে। কারণ সকাল সাড়ে ৭টার আগে ওই বাসায় নিহত নাজনীনের বড় বোন ইয়াছমিন ছিল। পুলিশ আব্বাসকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার স্টেশন থেকে গ্রেফতার করেছে। তিনজনকে হত্যা এবং নিজের সন্তানকে কুপিয়ে আহত করে সে ঘটনা আড়াল করতে সিদ্ধিরগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনের ভেতরে একটি বিয়েবাড়িতে খানসামার কাজ করছিল।