ইরাকের বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সামরিক ব্যক্তিত্ব জেনারেল কাসেম সোলাইমানি কুদস বাহিনীর প্রধান হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের কৌশলগত কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিতেন।
তাকে হত্যা করায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘চরম প্রতিশোধ’ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। তবে কীভাবে বা কোথায় এই প্রতিশোধ নেওয়া হবে, ইরান পাল্টা সামরিক হামলা চালাবে কি-না বা সাইবার আক্রমণ চালানো হবে কি-না– তা নিয়ে সামরিক কৌশল বিশেষজ্ঞরা নানা রকম বিশ্লেষণ দিচ্ছেন।
জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ মারান্দি জানান, এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য ধরে রাখার পরিকল্পনা পরাজিত করার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব নষ্ট করতে চেয়েছিল, ইরাককে দখলে রাখতে চেয়েছিল, ইসরায়েল লেবাননে দখলদারি করতে চেয়েছিল, সৌদি আরব এবং মার্কিনিরা ইয়েমেনকে পদানত করতে চেয়েছিল। জেনারেল সোলাইমানি এই মার্কিন আধিপত্যের সবগুলো পরিকল্পনাই বানচাল করে দিয়েছেন। মার্কিনিদের সাম্রাজ্য কায়েমের চেষ্টায় তিনি ছিলেন কাঁটার মতো। এটাই তাকে হত্যা করার কারণ।’
তবে সোলাইমানির শূন্যস্থান পূরণ হবে না, বা তাকে ছাড়া ইরানের আঞ্চলিক নীতি এগিয়ে নিতে সমস্যা হবে– এমনটা মানতে নারাজ মারান্দি। তার মতে, জেনারেল সোলাইমানির স্থলে কুদস ফোর্সের নতুন কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করা জেনারেল ইসমা্ইল ঘানিও একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সোলাইমানির যোগ্য সহযোগীদের নিয়ে তিনি নতুন চিন্তা ও নতুন নির্দেশনা নিয়ে সফলভাবে কাজ করবেন বলে মনে করেন মারান্দি।
তিনি বলেন, ‘জেনারেল সোলাইমানি একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের লোক ছিলেন। তার স্থলে যিনি এসেছেন তিনিও অভিজ্ঞ। তা ছাড়া ইরান কোনো একক ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই জেনারেল সোলাইমানির স্থান পূরণ হবে না– বিষয়টি এমন নয়।’
তার মানে কী এই যে, যুক্তরাষ্ট্র যা ভেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা পূরণ হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে মারান্দি বলেন, ‘আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো কাজ করেছে। এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এতে ইরান আরও ক্রুদ্ধ হয়েছে, ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলা করতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।’
তার মতে, সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে ইরানকে আরও শক্তিশালী করে দিয়েছে। মার্কিন হামলায় একজন ইরাকি কমান্ডারও নিহত হওয়ায়, ইরাক ও ইরান উভয় দেশের বিরুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্র এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধ ঠেকাতেই হামলা চালিয়ে জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গ তুললে ড. মারান্দি বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) তো নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়লেন। আমার মনে হয় না, ইরানের কেউই ট্রাম্পকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। বরং এই হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দুই দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, যা তাদেরই ক্ষতি করবে।’
ইরান এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলে আসছে, সেই প্রতিশোধ কী ধরনের হতে পারে, সেটা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। ইরানিরা পরিশীলিত জাতি, মার্কিনিদের মতো অমার্জিত ও পাশবিক নয়– দাবি করে মারান্দি বলেন, ‘ইরানিরা রাজনীতি করে দাবা খেলোয়াড়ের মতো। তারা হিসাব করে, অনেক চিন্তা ভাবনা করে এমন কিছু করবে, যাতে মার্কিনিরা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করে।’
ইরানের এই প্রতিশোধ নিয়ে নানা গুঞ্জন উঠেছে। এ আক্রমণ কী সামরিক হবে না সাইবার আক্রমণ হবে, মধ্যপ্রাচ্যে হবে না উত্তর আফ্রিকায় হবে, নানা জল্পনা চলছে। আসলে কী ঘটবে– এমন কোনো ধারণা দিতে পারেননি মারান্দিও। তবে তিনি বলেন, ইরানি ও ইরাকিদেরও নানা ধরনের সক্ষমতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দুর্বল জায়গা রয়েছে।
তার মতে, ইরানিরা অনেক ভাবনা-চিন্তা করে উপযুক্ত জবাব কী হবে তা ঠিক করবে, যাতে মার্কিনিদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে হয়। তবে কী হবে সেটা এখনই বলা যাবে না।
ইরান কোনো হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র আবার পাল্টা হামলা চালাতে পারে– এমন আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা জবাব সামলে নেওয়ার ব্যাপারে ইরান কতটা প্রস্তুত? এ বিষয়ে মারান্দি জানান, ইরান যে যুক্তরাষ্ট্রকে শাস্তি দেবে– এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, ‘ইরানিরা যুদ্ধ চায় না। তবে যুদ্ধ বাধলে তারা পালিয়ে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে তা যুদ্ধের শামিল। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে, ইরান শাস্তি দেবে। আমেরিকান, সৌদি এবং আমিরাতের যা আছে ইরান তা সব ধ্বংস করে দেবে। তখন আমেরিকানরা বুঝবে যে তারা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।’
এক্ষেত্রে ইরানের শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে থাকা মিত্র দেশগুলো। এ ছাড়া মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইরানের অনেক রকম সক্ষমতা আছে বলেও মনে করেন মারান্দি।
তার মতে, ‘ইরান কঠোর না হলে আমেরিকানরা আবার এমন কাজ করবে। আমেরিকা জানে, ইরানে তারা যদি আবার আক্রমণ চালায় তাহলে ইরানের জবাব হবে আরও তীব্র। আমেরিকানরা জানে যে, এ যুদ্ধে তারা জিততে পারবে না।’
জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্র দেশগুলোয় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন মারান্দি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইরান থেকে লেবানন পর্যন্ত যে শিয়া ক্রিসেন্ট রয়েছে তার পাশাপাশি সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানের সুন্নি সম্প্রদায়ও ইরানের মিত্রদেশ। জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুতে তারা এক হয়ে আরও শক্তিশালী হবে। আমেরিকা খুবই বোকার মতো একটা কাজ করেছে।’
ইরান সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থাকায় তাদের সামরিক সংঘাতে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে মারান্দি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রকেই অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় দেখছেন। তার মতে, দুই দেশের মধ্যে কোনো সংঘাত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি বেশি হবে।