চেয়ারম্যানের পদের পর এবার সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবির বিরোধ চরমে উঠেছে।
জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করতে জাতীয় পার্টির প্যাডে পাঠানো চিঠি নিয়ে আপত্তি তুলে দলটির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ পাল্টা চিঠি দিয়েছেন স্পিকারকে।
বুধবার পাঠানো এই চিঠিতে বলা হয়েছে, দলীয় ফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই জি এম কাদের মঙ্গলবার স্পিকারকে চিঠি দেন, যে চিঠিতে তাকে বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করার আহ্বান জানানো হয়।
স্পিকারকে চিঠি পাঠানোর আগে গুলশানের বাড়িতে সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য ও সংসদ সদস্যকে নিয়ে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন।
ওই বৈঠকের পর জানানো হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন রওশন।
স্বামী এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলা রওশন এই প্রথম গণমাধ্যমের সামনে আসতে যাচ্ছেন।
এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসা জি এম কাদের বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সম্মতি নিয়েই তাকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে চিঠিটি পাঠানো হয়।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান এরশাদ বেঁচে থাকার সময়ও স্ত্রী ও ভাইয়ের বিরোধ সামাল দিয়ে চলছিলেন। ভাইকে উত্তরসূরি ঘোষণা করে ভাই কাদেরকে দলে নিজের পরের স্থানটি দিতে কো-চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি; তাতে রওশন ক্ষুব্ধ হওয়ার পর তার জন্য জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানের আরেকটি পদ সৃষ্টি করা হয়।
গত জুলাই মাসে এরশাদ মারা যাওয়ার পর জি এম কাদের ভাইয়ের ‘ইচ্ছায়’ চেয়ারম্যানের পদ নেওয়ার পর তা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রওশন। এরপর মঙ্গলবার স্পিকারকে জি এম কাদের চিঠি পাঠানোর পর দুই পক্ষই এখন মুখোমুখি।
চিঠিতে জি এম কাদের লিখেছিলেন, এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদে তাকে বসাতে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলী সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দলের ২৫ জন্য সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও তাতে সমর্থন দিয়েছে।
ওই চিঠি নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন রওশনের অনুসারীরা; যারা জি এম কাদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়েও আপত্তি তুলেছিলেন।
বুধবার বিকালে স্পিকারের কার্যালয়ে বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশনের সই করা চিঠিটি নিয়ে যান জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু।
তিনি বলেন, “জি এম কাদের সংসদে দলের প্রধান হতে যে চিঠি দিয়েছেন, তা যথাযথ হয়নি জানিয়ে এই চিঠি দিয়েছেন রওশন ম্যাডাম। দলীয় ফোরামের সিদ্ধান্ত ছাড়া ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে এই চিঠিতে বলা হয়েছে।”
রওশনের বাড়িতে বৈঠক
স্পিকারকে চিঠি লেখার আগে বুধবার দুপুর ১২টায় রওশন তার গুলশানের বাড়িতে দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে নিয়ে বৈঠক করেন।
বৈঠকে ছিলেন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর তিন সদস্য ও সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু ও ফখরুল ইমাম।
জি এম কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত হলেও রওশনের বাড়িতে এ বৈঠকে যোগ দেন জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু।
আড়াই ঘণ্টার বৈঠক থেকে বেরিয়ে চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, “জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির কোনো বৈঠক ছাড়া স্পিকারকে দেওয়া জি এম কাদেরের চিঠিটির কোনো দাম নাই।”
তিনি বলেন, ““জি এম কাদের পার্লামেন্টারি কমিটির কোনো বৈঠক না করেই লুকিয়ে এই চিঠি দিয়ে থাকলেও আমি ও আমরা সে বিষয়ে কিছু জানি না। আমি তো এক নগণ্য এমপি। আমাকে তো কোনো নোটিস বা ফোন দেওয়া হয়নি। যে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে শুনছি, সেটি প্রপার না।”
রওশন এরশাদ
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, আগামী বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় রওশন এরশাদ তার বাড়িতে ‘জরুরি সংবাদ সম্মেলন’ ডেকেছেন। এতে দলের রাজনীতি নিয়ে রওশন এরশাদ নিজেই সাংবাদিকদের ব্রিফ করবেন।
চুন্নু বলেন, বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে একমাত্র রওশন এরশাদই জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক ডাকতে পারেন।
“জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সাংসদের সেন্টিমেন্ট রওশন এরশাদের পক্ষে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পর তারা তাকেই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চান, দেখতে চান সংসদে নেতা হিসেবেও,” বলেন চুন্নু।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন করতে গেলে পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক ডাকার এখতিয়ার একমাত্র উপনেতা রওশন এরশাদেরই আছে। যেহেতু সংসদে আমাদের নেতা নাই, উপনেতা আছেন। তিনি তো ডাকবেন সভা।”
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা মন্ত্রী এবং উপনেতা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পান। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নিয়োগ দেন স্পিকার।
কাদেরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও চুন্নু।
আনিসুল বলেন, “আমার জানামতে, উনি (জি এম কাদের) এখনও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তো উনি চেয়ারম্যান হননি। কোনো এক জন একটা মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে বলবে, আমি চেয়ারম্যান… এটা তো হতে পারে না।”
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও চুন্নু এসময় একযোগে বলেন, ‘হি ইজ নট চেয়ারম্যান’।
আগেও তো এভাবে হয়েছে: কাদের
জি এম কাদের দাবি করেছেন, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ভাই এরশাদ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন, তিনিও সেভাবেই নিয়েছেন।
তিনি বুধবার বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, “বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়ন প্রশ্নে জোর করে কিছু করা হয়নি। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
চুন্নু, আনিসুলদের নানা জানানোর অভিযোগ নিয়ে কাদের বলেন, “আমরা ফোনে সংসদ সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছি। তারা সম্মতি দিয়েছে। লিখিত দিতে বলা হলে ১৫ জন সম্মতিপত্র দিয়েছে।
“২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন সম্মতি দিলে আর কিছু লাগে না। তাই অন্যদেরকে বলা হয়নি। এখন আরও অনেকে দিতে চাচ্ছে। প্রয়োজন নেই বলে নেওয়া হচ্ছে না।”
সংসদীয় দলের বৈঠক না করার নিয়ে তিনি বলেন, “এরশাদ সাহেব যখন বেঁচে ছিলেন, তিনিও কিন্তু এভাবে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন, আমাকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করেছিলেন। পরে আমাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে উপনেতা করা হয়, তখনও কিন্তু পার্লামেন্টারি পার্টির কোনো মিটিং হয়নি।”
সংসদীয় দলের সভা ডাকার এখতিয়ারও তার বলেই দাবি করেন জি এম কাদের।
“অন্য কেউ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা ডাকতে পারে না। ডাকতে হলে আমিই ডাকব।”
এদিকে এরশাদের মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়েও এরশাদ পরিবারে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব।
রওশন এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদ ওই আসনে প্রার্থী হতে মঙ্গলবার দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন এরশাদের ভাই মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে মকবুল হোসেন শাহরিয়ার আসিফও।
সাদ ও আসিফ সমর্থকরা ইতোমধ্যেই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। রংপুরে দুপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে মারামারিও হয়েছে।
মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন জি এম কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত দলের যুগ্ম মহাসচিব এস এম ইয়াসির; যিনি রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক।