কুড়ি বছরেও এতটুকু রঙ চটেনি, বিসিবির পুরনো লোগোতে লাল বলের মাঝে বাঘের মুখচ্ছবিটাও জ্বলজ্বল করছে! গতকাল ১৯৯৯ সালের প্রথম বিশ্বকাপে যাওয়া সেই কোটটি গায়ে জড়িয়েই সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন নির্বাচকপ্রধান মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। সেবার ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন নান্নুর মতো একঝাঁক স্বপ্নিল তরুণ। আবার সেই রানীর দেশ ইংল্যান্ড- লর্ডস, ওভাল ও কার্ডিফে আরও একটি বিশ্বকাপ। এবার টাইগারদের এই স্বপ্নযাত্রায় অভিজ্ঞতার ওপরই ভরসা রাখা হয়েছে। আস্থা রাখা হয়েছে সাহসী আর পরীক্ষিত পারফরমারদের ওপরই। আর তাই মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের স্কোয়াডে হৈচৈ ফেলে দেওয়ার মতো তেমন কোনো চমক নেই। যা ছিল তা কেবলই তাসকিনের চোখের জলে ভারি হয়ে ওঠা মিরপুরের একাডেমির চত্বর। আট বছর আগে একদিন এই চত্বরেই কেঁদেছিলেন মাশরাফি, নিষ্ঠুর ইনজুরিই ২০১১ বিশ্বকাপের স্কোয়াড থেকে ছিটকে দিয়েছিল মাশরাফিকে। এবার সেই দুর্ভাগ্যই মেনে নিতে হলো তাসকিনকে। তার বদলে দলে সুযোগ পাওয়া আবু জায়েদ রাহিও অবশ্য কম ভাগ্যবান নন। ওয়ানডেতে অভিষেক না হয়েও বিশ্বকাপের মতো মহামঞ্চে ডাক এসেছে তার শুধুই ‘সুইং বোলার’ হিসেবে। শেষ বেলার টিম সিলেকশনে পেসার শফিউলকে টপকে রাহির স্কোয়াডে আসাই ছিল গতকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজ।
ফেসবুকের দেয়াল অবশ্য উত্তপ্ত ছিল ইমরুল কায়েসের বাদ পড়া, তাসকিনের কান্না আর সৌম্য-লিটনের অফফর্ম নিয়ে! অবশ্য এসব প্রশ্নেরই উত্তর ব্যাখ্যাসহ বর্ণনা করেছেন নির্বাচকপ্রধান মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তাসকিনের ব্যাপারে তার সাফ জবাব, ম্যাচ ফিটনেসের ঘাটতি। প্রায় দু’বছর আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা তাসকিনকে এ মুহূর্তে নেওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তামিমের ওপেনিং পার্টনার হিসেবে একজন ডানহাতিকেই নেওয়া হয়েছে। এই কারণে ইমরুল কায়েসকে টিম কম্বিনেশনে আনতে পারেননি আর সৌম্য-লিটন সুযোগ পেয়েছেন পরীক্ষিত পারফরমার হিসেবে। নান্নুর বিশ্বাস, এবারের বিশ্বকাপেও শেষ চারে খেলার সামর্থ্য রাখে টাইগারদের এ দলটি। ‘ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপটি হচ্ছে, সুতরাং এখানে আমরা অভিজ্ঞতাকে বেশি মূল্যায়ন করেছি। আর ওখানকার কন্ডিশন উপমহাদেশ থেকে ভিন্ন। আমরা কিন্তু এক বছর আগেও ওখানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে এসেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করেই কিন্তু অভিজ্ঞ দল সাজানো হয়েছে। এ মুহূর্তে এটাই বিশ্বকাপের জন্য আমাদের সেরা দল। ‘সাত ব্যাটসম্যান, চার অলরাউন্ডার আর চার পেসার দিয়ে বিশ্বকাপের স্কোয়াড সাজিয়েছে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু আর হাবিবুল বাশার সুমনের নির্বাচক কমিটি। এমনিতেই ১৩ জনের জায়গা পাকাই ছিল, গত কয়েকদিন কোচ স্টিভ রোডস, অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা আর বিসিবিপ্রধান নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করে স্কোয়াডের শেষ দুই সদস্যকে নির্বাচিত করা হয়েছে। প্রথমে টপ অর্ডারে ব্যাকআপ হিসেবে ইয়াসির আলী রাব্বির কথা চিন্তা করেছিল নির্বাচক কমিটি। সেই সঙ্গে চতুর্থ পেসার হিসেবে শফিউল ইসলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মিরাজের ব্যাকআপ হিসেবে একজন স্পিন অলরাউন্ডার নেওয়ার জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন মাশরাফি। সে যুক্তিতেই শেষ মুহূর্তে দলে চলে আসেন মোসাদ্দেক। আর বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের সুপারিশে চতুর্থ পেসার হিসেবে ডাক পান আবু জায়েদ রাহি।
ঢাকা লীগে সম্প্রতি রান না পাওয়ায় সৌম্য সরকারকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন নির্বাচকরাও। কিন্তু কোচ স্টিভ রোডস আর অধিনায়ক মাশরাফির জোরালো সমর্থনে স্কোয়াডে চলে আসেন তিনি। দলের বিদেশি কোচিং স্টাফদের মধ্যে ঢাকায় চলে এসেছেন ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারানে। ২২ এপ্রিলে মিরপুরে বিশ্বকাপ ক্যাম্পের আগে চলে আসবেন স্টিভ রোডসসহ বাকিরাও। সাকিবকেও ওই সময় ক্যাম্পে থাকার নির্দেশ দিয়ে ই-মেইল করা হয়েছে। মিরপুরে প্রায় এক সপ্তাহের ক্যাম্প শেষে ১ মে আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি ওয়ানডে সিরিজ খেলতে যাবে বাংলাদেশ দল। স্বাগতিক আয়ারল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই সিরিজে কিছু ক্রিকেটারের পারফর্ম মূল্যায়ন করা হবে বিশ্বকাপের জন্যও। কেননা আইসিসির নতুন নিয়মে ২৩ মে পর্যন্ত ইনজুরি ছাড়াও স্কোয়াডে পরিবর্তন আনা সম্ভব। সে কারণেই স্পিনার নাঈম হাসান আর টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান ইয়াসির আলীকেও রাখা হয়েছে ওই সিরিজে। আয়ারল্যান্ড থেকেই টাইগাররা ইংল্যান্ডে চলে যাবে। সেখানে লেস্টারশায়ারেই এক সপ্তাহের বিশেষ ক্যাম্প করবেন মাশরাফির। ৩০ মে থেকে বিশ্বকাপ শুরু হলেও বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষ। তার আগে অবশ্য ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ রয়েছে টাইগারদের। সব মিলিয়ে টানা প্রায় ১৩ থেকে ১৪টি ওয়ানডে খেলতে হবে মাশরাফি-সাকিবদের।
তাই সব কিছুর ওপর ক্রিকেটারদের ফিটনেসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এমনিতেই এবারের বিশ্বকাপ ফরম্যাট একটু ভিন্ন। প্রতিটি দলের বিপক্ষে একটি করে মোট ৯টি ম্যাচ খেলতে হবে টাইগারদের।
তাই ১৫ জনের স্কোয়াড ঘোষণা করলেও মোট ২০ জনের একটি দল প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে ১৭ জনের দল গেলেও মিরপুরে আরও তিন ক্রিকেটারকে আলাদা ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রস্তুত রাখা হবে। সেখানে তাসকিন ছাড়াও আরও দুই ক্রিকেটার থাকছেন বলে নিশ্চিত করেছেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তবে ওই বাকি দুই ক্রিকেটারের নাম তিনি এখনই বলতে রাজি হননি। গতবারের বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে এবারে সুযোগ পেয়েছেন মোট আটজন- মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, সৌম্য, সাব্বির এবং রুবেল। তাদের মধ্যে মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক আর তামিমের এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ। হয়তো মাশরাফির জন্য এটি শেষ বিশ্বকাপ। তাই এবারের আসরটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যক্তিগত পছন্দের বাইরে টিম কম্বিনেশনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন অধিনায়ক। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন লিটন, মিঠুন, মুস্তাফিজ, রাহি, মিরাজ, সাইফউদ্দিন ও মোসাদ্দেক। গত দুই বছর ঘুরেফিরে এরাই ছিলেন মাশরাফির ওয়ানডে স্কোয়াডে। তাই তাদের ওপরই আস্থা রেখেছেন তিনি।
নিউজিল্যান্ড সফরের ব্যর্থতা কিংবা সম্প্রতি ঢাকা লীগের পারফর্ম দিয়ে মাশরাফির এই সিদ্ধান্তকে খুব বেশি টলাতে পারেনি। শুধু দলে একজন লেগ স্পিনারের অভাব বোধ করেছেন তিনি। মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি নামের এক লেগ স্পিনারকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন রংপুর রাইডার্সের নেটে। তবে বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে অনভিজ্ঞ ওই আফ্রিদিকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি নিতে চায়নি টিম ম্যানেজমেন্ট। দু’বছর আগে এই ইংল্যান্ডেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে টাইগারদের। তা ছাড়া গেল বিশ্বকাপের পর ৫১ শতাংশ ওয়ানডে জিতেছে এ দলটিই। তাই মাশরাফির লালিত এই দলটিকে নিয়ে খুব বেশি কাটাছেঁড়া করার ঝুঁকি নেননি নির্বাচকরাও। ‘এই দল গঠন করতে পেরে অবশ্যই সন্তুষ্ট আমরা। যেহেতু ইংল্যান্ডে খেলা। সুতরাং অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করা হয়নি। আমি যখন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ছিলাম তখন কিন্তু ইংল্যান্ডে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল আমার। আমাদের ক্রিকেট এখন এগিয়ে যাওয়ার পথে। আমার বিশ্বাস, এবারের বিশ্বকাপেও ভালো করবে বাংলাদেশ। কুড়ি বছর আগে যে স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন যেন এত বছর পরও একই আছে। মানুষটির হৃদয়টি বদলায়নি, বদলেছে শুধু ভূমিকাটি- সেবার ছিলেন বিশ্বকাপের ক্রিকেটার, এবার বিশ্বকাপের নির্বাচক। ‘এটি আমার সৌভাগ্যের কোট। তাই এটাই আজ পরে এলাম।’ পুরনো কোটটি দেখিয়ে যেন স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।