স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পে অগ্রগতি নেই। দীর্ঘদিন ধরেই এমন অচলাবস্থা। গোপালগঞ্জে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্প ৯ বছরেও শেষ হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এই প্রকল্প সম্পর্কে মন্তব্য করেছে- ‘জাতির জনকের নামে নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতি মন্থর। ৯ বছরেও প্রকল্পটি শেষ হয়নি। সংশোধিত মেয়াদ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে আরো যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।’
সম্প্রতি সংসদের সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় কমিটি উষ্ফ্মা প্রকাশ করে বলেছে, ‘স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’ ওই বৈঠকে আইএমইডির অতিরিক্ত সচিব কামরুজ্জামানের উপস্থাপিত কার্যপত্রে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ৫০টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ১৫টি প্রকল্প রয়েছে। যার অধিকাংশেরই বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। দুই বিভাগের মোট ৬৫ প্রকল্পের মধ্যে ১৬টির অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাকি ৪৯ প্রকল্পের অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রকল্পের সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়াদের আড়াই বছর পার হওয়ার পরেও আর্থিক অগ্রগতি মাত্র আড়াই ভাগ। কোনোটির নির্মাণকাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও জনবলের সংস্থান না হওয়ায় নির্মাণোত্তর স্থাপনা অব্যবহূত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। আবার নির্মাণধর্মী প্রকল্প সমাপ্ত করলেও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে সেবা দিতে পারছে না। সৌদি সহায়তায় দুটি প্রকল্পে যথাসময়ে অর্থ ছাড় না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বে হয়েছে। ভারতীয় ঋণের আওতায় বাস্তবায়নাধীন তিনটি প্রকল্পের অগ্রগতি তুলনামূলক কম।
বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা) স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ২৭টি, চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি অপারেশনাল প্ল্যান ১৯টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প তিনটি, জেডিসিএফের অর্থায়নে বিনিয়োগ প্রকল্প একটি। একই অর্থবছরে এডিপিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মধ্যে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি অপারেশনাল প্ল্যান ১০টি এবং বিনিয়োগ প্রকল্প পাঁচটি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এসব প্রকল্পের জন্য আরএডিপিতে (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা) বরাদ্দ ছিল আট হাজার ২৬১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জিওবি পাঁচ হাজার ৯১১ কোটি এবং প্রকল্প সাহায্য ছিল দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এই বারদ্দ মোট আরএডিপির চার দশমিক ৬৮ ভাগ। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে সাত হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে জাতীয় অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ৩৬ ভাগ হলেও এই বিভাগের অর্জন ৮৮ দশমিক ৭৭ ভাগ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৮২৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে জিওবি প্রায় ৯৬০ কোটি এবং প্রকল্প সাহায্য প্রায় ৮৬৫ কোটি টাকা, যা মোট আরএডিপির এক দশমিক শূন্য তিন ভাগ। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৩৭৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই অর্থবছরে জাতীয় অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ৩৬ ভাগ হলেও এই বিভাগের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪২ ভাগ।
৩১ জুলাই সরকারি প্রতিশ্রুতি কমিটির সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন হয় ১৯ আগস্ট। ওই বৈঠকের কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আলী আশরাফের সই করা কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কমিটির সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, প্রকল্পগুলোতে অর্থ বরাদ্দ সত্ত্বেও তা ব্যয় করতে না পারায় অর্থ ফেরত যায়। এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কমিটির আরেক সদস্য বিকল্পধারার এমপি আব্দুল মান্নান বলেন, আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী এই মন্ত্রণালয়ের সন্তোষজনক প্রকল্পের সংখ্যা খুবই কম। বাস্তবায়ন অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সন্তোষজনক নয়। কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম-৮ আসনের এমপি মইনউদ্দীন খান বাদল জানান, ২০১০ সালে দেওয়া একটি অত্যাধুনিক এক্সরে মেশিন চালানোর জন্য দক্ষ লোক না থাকায় সেই মেশিন অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। দক্ষ লোকবল না থাকলে এই মেশিন কেন দেওয়া হলো, তা তিনি জানতে চান।
বৈঠকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, সৌদি সহায়তায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের ফান্ডিং নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সৌদির ফান্ড রিলিজ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। এ ছাড়া কিছু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে সমস্যা হওয়ায় তা বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি মনে করেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।
বৈঠকে শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে তিনটি বিভাগে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে আর দুটির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। একটির ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান। এ ছাড়া চাঁদপুরে একটি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপনের বিষয়ে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রকল্পগুলোর বর্তমান চিত্র : আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফিজিক্যাল ফ্যাসেলিটিজ ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নির্মাণকাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও জনবলের সংস্থান না হওয়ায় নির্মাণোত্তর স্থাপনা অব্যবহূত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
‘আই হেলথ প্রমোশন অ্যান্ড প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেস ইন সিলেকটেড এরিয়াস অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পটি কোরিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন। হাসাপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হলেও জনবলের অভাবে কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না।
‘শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট’ ২০১২ সালের মার্চে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার জন্য নির্ধারিত এবং ‘সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন’ ও ‘কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন’ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়া কথা থাকলেও তিনটি প্রকল্পেরই নির্মাণ কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতির হওয়ায় বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।
‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেন্স সেন্টার’ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু জনবল পদ সৃজন না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।
‘এক্সটেনশন অব শহীদ শেখ আবু নাসের স্পেশালাইজড হাসপাতাল, খুলনা’ ২০১২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সম্প্রতি মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে গত ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিচালক ছিল না। ফলে কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জনবলের অভাবে মূলত প্রকল্পটি বিলম্বিত হচ্ছে।
‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব শেখ লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজ, গোপালগঞ্জ’- এই প্রকল্পটি ২০১৪ সালে শুরুর কথা থাকলেও সম্প্রতি নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। যথাসময়ে কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম শুরুর জন্য এখনই সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাবার নামে প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যয় বাড়ল ৭০ ভাগ : মানিকগঞ্জে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ৭০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। ‘কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ ও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন, মানিকগঞ্জ’ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার জন্য নির্ধারিত ছিল। প্রকল্পের প্রথম সংশোধনের পিইসি সভায় ৭০ ভাগ ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।