প্রচণ্ড গরম আর ক্লান্তি-শ্রান্তিতে প্রায় নুয়ে পড়া শরীর। সেসবকে জয় করেই দিনের শেষ সেশনে পুরনো বলে আগুন ঝরা বোলিং! দেড় যুগ আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই বোলিংয়ের স্মৃতি এখনও নাড়া দেয় মঞ্জুরুল ইসলামকে। দুর্দান্ত স্পেলে তার রিভার্স সুইংয়ের শিকার ছিলেন সনাৎ জয়াসুরিয়া। বাংলাদেশের সাবেক বাঁহাতি পেসারের হৃদয়ে অনুরণন তোলে আরেকটি ম্যাচে ব্রায়ান লারাকে রিভার্স সুইংয়ে বোল্ড করার স্মৃতিও।
জয়াসুরিয়াকে আউট করা ম্যাচটি ছিল ২০০২ সালে কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে, টেস্টের প্রথম দিনে। দারুণ বোলিংয়ে সেদিন থিলান সামারাবিরা ও প্রসন্ন জয়াবর্ধনেকেও আউট করেছিলেন মঞ্জু।
লারার সঙ্গে মঞ্জুর দ্বৈরথ জমেছিল ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন বাংলাদেশে এসেছিল একটি তিন দিনের ম্যাচ ও দুটি ওয়ানডে খেলতে। তিন দিনের ম্যাচে লারাকে বোল্ড করেছিলেন মঞ্জু রিভার্স সুইংয়ে। পরে প্রথম ওয়ানডেতে ক্যারিবিয়ান গ্রেটকে ফেরান ২ রানে।
মঞ্জুকে নিয়ে তখন দেশের ক্রিকেটে দারুণ শোরগোল। গ্যালারিতে ‘মঞ্জু বনাম লারা’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে গিয়েছিল দর্শক। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অবশ্য ৪৫ বলে সেঞ্চুরি করে লারা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার শ্রেষ্ঠত্ব।
মঞ্জুর স্মৃতিতে উজ্জ্বল ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ কিছু পারফরম্যান্সও।
‘আমার ক্যারিয়ারের সেরা স্পেল’
“অভিষেক টেস্টে ৬ উইকেট নিয়েছিলাম আমি। সেখানে ছিল অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো ব্যাটসম্যানের উইকেটও। স্মরণীয় পারফরম্যান্স আমার আরও কিছু আছে। তবে নিজের মতে, আমার ক্যারিয়ারের সেরা দুটি স্পেল করেছিলাম শ্রীলঙ্কায়, ২০০২ সালে।”
“প্রথম দিনে আমরা বোলিং করছিলাম। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠের উইকেট বরাবরই ব্যাটিং স্বর্গ। তবে উইকেটের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কন্ডিশন। জুলাই মাস তখন, ভয়ঙ্কর গরম। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। তাপ যেন কাঁটা দিচ্ছিল শরীরে। প্রচণ্ড ঘেমে নেয়ে একাকার ছিল সবাই। মনে আছে, ক্র্যাম্প হওয়ায় মাঠ ছেড়ে গিয়েছিল তাপস (বৈশ্য) ও সুমিত (অফ স্পিনার ফাহিম মুনতাসির)। সুমিতকে তো হাসপাতালে নেওয়ার অবস্থা হয়েছিল।”
“আমরা শুরুটা ভালোই করেছিলাম। নতুন বলে তালহা (জুবায়ের) ও তাপস খুব ভালো বোলিং করেছিল। পরে সুমিত এসে দুটি উইকেট নিল। কিন্তু পঞ্চম উইকেটে জয়াসুরিয়া ও সামারাবিরা ভালো একটা জুটি গড়ল। জয়াসুরিয়া তখন অধিনায়ক, ওই ম্যাচে পাঁচে ব্যাট করেছিল।”
“ওদের জুটি মনে হয় দেড়শ রানের মতো হয়ে গিয়েছিল। পাইলট ভাই (অধিনায়ক খালেদ মাসুদ) আমাকে বোলিংয়ে আনলেন আবার, তখন ৭০ ওভার হয়ে গেছে। দিনের শেষ সেশন, শরীর যেন চলছিল না। বল হাতে নেওয়ার পর অন্যরকম একটা শক্তি পেলাম যেন। মনে হলো, চেষ্টা করি, তারপর যা হয়।”
“জয়াসুরিয়ার রান তখন ৮০’র বেশি, খেলছিল ওয়ানডের গতিতে (৯৪ বলে ৮৫)। আমি রিভার্স পাচ্ছিলাম দারুণ। একটা বল করতে পারলাম নিখুঁত। অফ স্টাম্পে পিচ করল, জয়াসুরিয়া খেলেছিল সোজা ব্যাটেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেরিয়ে গিয়ে তার ব্যাটের কানায় লেগে কিপারের গ্লাভসে গেল।”
“ওই ওভারেই আউট করে দেই প্রসন্নকে (০)। এবারও রিভার্স সুইং ও পাইলট ভাইয়ের ক্যাচ। ৫ ওভারের ওই স্পেল শেষ হওয়ার পর মিনিট পনের বিরতি পেয়েছিলাম। এরপর আরেকটি স্পেল, এবার আরও বড় (৭ ওভার)। ওই স্পেলে আউট করেছি সামারাবিরাকে (৫৮)। এটাও ছিল রিভার্স ও ক্যাচ গেছে উইকেটের পেছনে (স্লিপে ক্যাচ নিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার)।”
“রিভার্স সুইংয়ের জন্য খুবই জরুরি দুটি ব্যাপার, খুব নতুন বলে সিমে হিট করতে হবে বেশি, যেন বল নষ্ট না হয়। আর খুব ভালো মেইনটেইন করতে হবে। এই দুই জায়গায় ঘাটতির জন্য আমরা রিভার্স বেশি করাতে পারি না।”
“নতুন বলে বোলার যদি সিমে হিট না করে বলের বডিতে হিট করতে থাকে, তাহলে স্পিনারদের জন্য ভালো হয় বটে, কিন্তু রিভার্সের সম্ভাবনা কমে যায়। অন্তত ৪০ ওভার পর্যন্ত বেশি বল সিমে বা আশেপাশে হিট করানো উচিত। আর, বলের একটা পাশ উজ্জ্বল রাখা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য মেইনটেইন খুব ভালোভাবে করতে হয়। অনেক দলে বল উজ্জ্বল করার জন্য আলাদা দায়িত্বই থাকে মাঠে কারও কারও। দারুণ দক্ষতার ব্যাপার, সবাই পারে না।”
“ওই টেস্টে আমাদের বল মেইনটেইন করা খুব ভালো হয়েছিল। এটা কাজে লেগেছিল আমার। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুটি স্পেল করেছিলাম ১২ ওভারের (ওই দুই স্পেল মিলিয়ে বোলিং ফিগার ছিল ১২-৩-১৫-৩), ওদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দেইনি। কন্ডিশন আর নিজের বোলিং, সব মিলিয়ে আমার ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং স্মৃতি সেটিই।”
“মনে আছে, দিনের খেলা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় সবার ওজন কয়েক কেজি করে কমে গিয়েছিল, প্রচণ্ড গরমে ঘেমে। কিন্তু মনে প্রশান্তি ছিল অমন পারফরম্যান্সের কারণে। ওই সময় আমরা নিয়মিত তিন দিনে ম্যাচ হারতাম। ভালো পারফরম্যান্স খুব কম আসত। ওই দিনটায় আমরা শ্রীলঙ্কার ৮ উইকেট নিতে পেরেছিলাম।”
লারা এবং অন্যান্য“লারা তো লারাই। আমার মনে হয়, বিশ্বের সব বোলারের কাছে লারার উইকেট স্মরণীয়। তিন দিনের ম্যাচে লারাকে যে আউট করেছিলাম, সেদিনও বল বেশ ভালো মেইনটেইন করা হয়েছিল আমাদের। লারা খুব মেরে খেলছিল (৭৬ বলে ৮৭)। একটা বল করতে পারলাম স্বপ্নের মতো। জয়াসুরিয়াকে আউট করা ডেলিভারির মতোই অনেকটা, কিংবা আরও ভালো। মিডল স্টাম্পে পিচ করা বলে লারা সোজা ব্যাটে ড্রাইভ করতে চেয়েছিল। বল শেষ মুহূর্তে বেরিয়ে অফ স্টাম্পে হিট করে। আমার কাছে ছবিটা আছে এখনও।”
“লারাকে বোল্ড করতে পারার আনন্দ তো বলার মতো নয়। পরে প্রথম ওয়ানডেতে তাকে আমার প্রথম ওভারেই আউট করলাম। বয়স কম তখন (২০ ছুঁইছুঁই), লারার মতো ব্যাটসম্যানকে পরপর দুইবার আউট করার অভিজ্ঞতা দারুণ রোমাঞ্চকর ছিল।”
“এছাড়াও ঘরোয়া ক্রিকেটের কিছু পারফরম্যান্স না বললেই নয়। কোনো ব্যাটসম্যানের সঙ্গে লড়াই বলে নয়, ওভারঅল পারফরম্যান্সের কারণে মনে আছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে বিকেএসপিতে একবার সোনারগাঁও ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ১০ ওভারে ৭ রান দিলাম। তখনকার রেকর্ড। পরে নিজেই সেই রেকর্ড ভেঙে ওরিয়েন্টের বিপক্ষে ১০ ওভারে দিলাম মাত্র ৩ রান! প্রথম যেবার কর্পোরেট লিগ টি-টোয়েন্টি হলো, বিমানের বিপক্ষে ৪ ওভারে রান দিয়েছিলাম কেবল ৩। জানি না নিশ্চিত করে, হয়তো সেটি এখনও রেকর্ড!”