ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরার পথে দিনভরই মারাত্মক সব দুর্ঘটনার খবর এসেছে; মহাসড়কের এক জায়গায় বাবা, মা ও সন্তান এবং আরেক পথে মা ও দুই ছেলেমেয়ের করুণ মৃত্যু হয়েছে। সবমিলিয়ে দিন শেষে সড়কে ঝরেছে ২৯ জনের প্রাণ।
সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার ১২ জেলায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বাহনে ঘটেছে এসব দুর্ঘটনা, যাদের সাতজনই নিহত হয়েছেন টাঙ্গাইলের দুই স্থানে।
আর বগুড়ায় চারজন, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জে তিনজন করে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও গাজীপুরে দুইজন করে, ঝিনাইদহ, কুমিল্লা, নীলফামারী, ঢাকা ও চট্টগ্রামে একজন করে মারা গেছেন।
আগের দিন শুক্রবারও সড়কে প্রাণ গেছে অনেকের। তবে দুর্ঘটনার ধরন ও সংখ্যায় শনিবার ছিল ভয়ংকর এক দিন।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর ;-
টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় দুই সড়ক দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত হয়েছেন।
ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে উপজেলার পাকুল্যা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ও ভাতগ্রাম ইউনিয়নের দুল্যা মনসুর এলাকায় বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত হন চার জন।
মির্জাপুরের গোড়াই হাইওয়ে থানার ওসি মোল্লা টুটুল জানান, মহাসড়কের মির্জাপুর উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়নের দুল্যা মনসুর এলাকায় শনিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
হতাহতের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ।
ওসি বলেন, বালুবোঝাই একটি ট্রাকের পেছনে ধনবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা বিনিময় পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের তিন যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে আহত অবস্থায় দশজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়।
এ দুর্ঘটনার পর মহাসড়কে ঢাকার দিকে যান চলাচল বন্ধ থাকে। যানজটে আটকা পড়ে কর্মস্থলগামী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর মির্জাপুর থানা পুলিশ দুর্ঘটনা কবলিত বাসটি সরিয়ে নিলে সকাল পৌনে ৭টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
তাছাড়া মির্জাপুর উপজেলায় সড়ক পার হওয়ার সময় বাসের চাপায় মা, মেয়ে ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে উপজেলার পাকুল্যা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এই দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে জানান ওসি মোল্লা টুটুল।
নিহতরা হলেন উপজেলার বাঁশতৈল গ্রামের পারভীন আক্তার (২৭), তার মেয়ে সাদিয়া আক্তার (৯) ও ছেলে সুমন (৭)।
দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা ঘটনাস্থলে ওভারব্রিজের দাবিতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এ সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ওসি মোল্লা টুটুল জানান, পারভীন আক্তার বাবার বাড়ি পানিসাইল থেকে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাঁশতৈলে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার জন্য পাকুল্যা বাসস্ট্যান্ডে আসেন।
মহাসড়ক পার হওয়ার সময় দ্রুতগতির একটি যাত্রীবাহী বাস তাদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মেয়ে সাদিয়া মারা যায়। গুরুতর আহত মা ও ছেলেকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলার জামুর্কী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাদের টাঙ্গাইল সদরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
শনিবার দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও অবরোধে অংশ নেন। তারা মহাসড়কের জনগুরুত্বপূর্ণ ওই স্থানে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ না করা পর্যন্ত অবরোধ তুলে নেবেন না বলে জানান।
অবরোধের কারণে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরা হাজারো যাত্রীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রশাসনের আশ্বাসে আড়াই ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন স্থানীয়রা।
ময়মনসিংহ
মর্মান্তিক আরেকটি দুর্ঘটনায় ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ট্রাক চাপায় স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান নিহত হন।
শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ত্রিশাল পৌর শহরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের খান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান ত্রিশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু বকর সিদ্দিক।
নিহতরা হলেন- উপজেলার রাইমনি গ্রামের ফকিরবাড়ির চল্লিশোর্ধ্ব জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী ত্রিশোর্ধ্ব রত্না আক্তার ও তাদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা আক্তার।
স্থানীয়দের বরাতে পরিদর্শক (তদন্ত) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চিকিৎসক দেখানোর জন্য জাহাঙ্গীর ত্রিশাল সদরে এসেছিলেন। সঙ্গে তাদের মেয়ে সানজিদাও ছিল।
তিনি বলেন, খান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক তাদের চাপা দেয়। এতে তিনজনেই ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। এই অবস্থায় রাস্তাতেই সন্তানের জন্ম দেন রত্না। তারপরই তিনি মারা যান। পাশেই পড়েছিল স্বামী জাহাঙ্গীরের মরদেহ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাইভেটকারের সঙ্গে সংঘর্ষে অটোরিকশার চালক ও এক যাত্রীর প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন আরও চারজন।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার উজানিসার এলাকার কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ওসি মোহাম্মদ এমরান হোসেন জানান।
মৃতরা হলেন- অটোরিকশা চালক সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের চাঁন মিয়া (৫০) ও যাত্রী কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন (৪৫)।
বগুড়া
বগুড়ার কাহালু উপজেলায় মিনি ট্রাকের সঙ্গে প্রাইভেটকারের সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়।
কাহালু থানার ওসি আমবার হোসেন জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার দরগাহহাট এলাকায় সজল ফ্যাক্টরির সামনে বগুড়া- নওগাঁ মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
মৃতরা হলেন- নওগাঁ জেলার ধামুরহাটের তানছের আলী (৬০), তার ছেলে টগর আলী (৩৫), মফিজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রহমান (৩৫) ও প্রাইভেটকার চালক পত্নীতলা এলাকার মান্নুর ছেলে সুমন (৩০)।
হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় বাসচাপায় অটোরিকশার চালকসহ তিনজন নিহত হয়েছেন; আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন।
শনিবার বিকেলে উপজেলার রুস্তমপুর টোল প্লাজার সামনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে তারা হতাহত হন বলে নবীগঞ্জ থানার ওসি ডালিম আহমেদ জানান।
নিহতরা হলেন অটোরিকশার চালক নবীগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কাঁচা মিয়ার ছেলে রব্বান মিয়া (৪৫), বেতাপুর গ্রামের আবুল মিয়ার স্ত্রী বকুল বেগম (৫৫) ও একই গ্রামের কচি মিয়ার ছেলে জাবেদ মিয়া (২৪)।
সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন।
শনিবার দুপুরে উপজেলার খালকুলা এলাকার হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ওসি লুৎফর রহমান জানান।
নিহতদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার কাদিমপাড়ার মৃত মনছের আলীর ছেলে মিরাজুল ইসলাম (৩৪) ও রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার উত্তর জামালপুর গ্রামের মৃত আতাবর রহমানের ছেলে আব্দুল আজিজ (৪২)। অপর একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
গাজীপুর
গাজীপুর মহানগরে শনিবার পৃথক স্থানে ট্রাক লেগুনা এবং দুই অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছেন।
শনিবার ভোররাতে গাজীপুর মহানগরের পুবাইল থানার বসুগাঁও এলাকায় ট্রাক-লেগুনা এবং সকাল সাড়ে ৮টার গাজীপুর মহানগরের পুবাইল থানাধীন সুকুন্দী ব্রিজ এলাকায় দুই অটোরিক্সা মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।
নিহতদের একজন হলেন লেগুনা যাত্রী শেরপুর সদরের মাঝপাড়া এলাকার গোলাম রাব্বানীর ছেলে মনিরুজ্জামান (৩৮) এবং অপরজন অটোরিকশার যাত্রী মো. ইব্রাহিম হোসেন (৩৪)। ইব্রাহিম নরসিংদীর মনোহরদী থানার কেরানীনগর এলাকার মো. ইদ্রিস আলীর ছেলে।
ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় লোকমান হোসেন (৯০ ) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও তিনজন। সকালে ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কে কালীগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বারোবাজার হাইওয়ে থানার এসআই মো. কামরুজ্জামান জানান, পেছন দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে রাস্তায় ছিটকে পড়ে লোকমান হোসেনসহ আরও চারজন গুরুতর আহত হন। সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিকে নেওয়া হলে লোকমান মারা যান। আহতদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশংকাজনক।
থানাতে কোনো মামলা হয়নি। পরিবারের সদস্যরা লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছেন।
কুমিল্লা
কুমিল্লার লালমাই উপজেলায় বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী বাঁশিবাদক মনির হোসেনের মৃত্যু হয়েছে।
উপজেলার হরিশ্চর এলাকার কুমিল্লা-নোয়খালী মহাসড়কে শনিবার ভোরে এ দুর্ঘটনায় আহত প্যাডবাদক বোরহান উদ্দিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় পিকআপ ভ্যান-অটোরিকশা সংঘর্ষে এক নারী নিহত হয়েছেন।
শনিবার সকাল ৮টায় উপজেলার ফটিকছড়ি-হুঁয়াকো সড়কে এ ঘটনা ঘটে বলে ভূজপুর থানার ওসি হেলাল উদ্দিন জানান।
নিহত শারমিন আক্তার (২৮) উপজেলার উত্তর শৈলকোপা এলাকার আবু তাহেরের স্ত্রী।
নীলফামারী
নীলফামারীর জলঢাকায় ট্রাকের ধাক্কায় আজিজুল হক (৪৫) নামে এক রিক্সাভ্যান চালক নিহত হয়েছেন।
শনিবার সকাল ১০টার দিকে জলঢাকা উপজেলার টেংগনমারী-মীরগঞ্জ সড়কের কিসামত বটতলা বাজারে ওই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন জলঢাকা থানার পরিদর্শক (এস.আই) নুরুল হক।
থানার পরিদর্শক ফিরোজ কবির জানান, কোনো অভিযোগ না থাকায় মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ট্রাকটি আটক করা হলেও চালক ও সহযোগী পালিয়ে গেছে।
ঢাকা
ঢাকার কারওয়ান বাজারে পান্থপথ মোড়ে বাসের ধাক্কায় রিকশাআরোহী এক যুবক নিহত হয়েছেন।
নিহতের নাম মো. ইব্রাহিম বিশ্বাস (২৪)। তার বাড়ি বরিশালের উজিরপুরের সাতলায়। তিনি পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারে থাকতেন। সেখানে মামার খাবার হোটেল দেখাশোনা করতেন তিনি।
শনিবার ভোর ৪টার দিকে কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে যাওয়ার পথে ইব্রাহিম দুর্ঘটনায় পড়েন।
রিকশাচালক জালাল উদ্দিন (৩৫) জানান, পান্থপথ মোড়ে একটি বাস তাদের রিকশায় পেছনে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যায়।
ধাক্কায় জালাল রাস্তার বাম পাশে পড়ে গিয়ে সামান্য আহত হন। ইব্রাহিম পড়ে গুরুতর আহত হন।
সেখান থেকে পথচারীরা তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক ইব্রাহিমকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের মামা কবির হোসেন জানান, ইব্রাহিম ঈদের দুই দিন পরে গ্রাম থেকে ঢাকার নাজিরা বাজারে তার বাসায় এসেছিল।
ইব্রাহিমের সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল বলে জানান তিনি।
শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) গোলাম মোস্তফা বলেন, পুলিশ বাসটি শনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছে।