কাগজে-কলমে ঢাকাসহ সারা দেশে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হলেও আইনের পূর্ণ বাস্তবায়নে আরও সময় নেওয়ার কথা বলছে পুলিশ।
যারা আইনটি প্রয়োগ করবেন, ট্রাফিক পুলিশের সেই কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনও আইনটি সম্পর্কে অবগত নন। এই আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই চালক-পথচারীদেরও।
শুক্রবার আইন কার্যকরের প্রথম দিনে ঢাকা মহানগরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি, নতুন আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুলিশের পস মেশিনের সফটওয়্যারও আপডেট হয়নি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে প্রচলিত আইনকে আরও কঠোর করে গত বছর সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়। ১ নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকরের জন্য ২৮ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
এই আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। আইন লংঘনে বেড়েছে জরিমানার অঙ্কও।
নতুন আইন নিয়ে চালক ও যাত্রীদের বক্তব্যে মিলেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শাস্তি কমানোর দাবি করছেন চালকরা।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে নতুন এই আইন
সড়কে শৃঙ্খলা আনতেই নতুন আইন জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা আমাদের বড় সঙ্কট। সড়ক-মহাসড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। সড়ক পরিবহন আইনটাও সেই জন্যই করা হয়েছে। এখন আমরা আটঘাঁট বেধেঁই নেমেছি। শৃঙ্খলা না থাকলে উন্নয়নের কোনো দাম নেই।”আইন কার্যকরে আরও সময় দরকার বলে মনে করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক দক্ষিণ) আবদুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, “নতুন আইন তো সব জায়গায় হুট করে প্রয়োগ করা যাবে না। মানুষ তো এখনও জানে না। ডিএমপির যেসব অফিসাররা আইনটা প্রয়োগ করবে তাদেরতো জানার দরকার আছে। তাদের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আমরা করেছি।”
শুক্রবার ছুটির দিনে এমনিতে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কম। তার মধ্যে নতুন আইন কার্যকরে বিশেষ কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
নতুন আইনে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ প্রচলিত আইনের চেয়ে বেশি, আইনের ব্যাখ্যায়ও আছে তফাৎ।
সে প্রসঙ্গ টেনে পুলিশ কর্মকর্তা রাজ্জাক বলেন, “এটা আমরা স্টেপ বাই স্টেপ প্রয়োগ করব। দেখা যাচ্ছে, কিছু দিন আগে যেখানে পাঁচশ টাকা জরিমানা ছিল, এখন হয়েছে আড়াই হাজার টাকা।”
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “এক জায়গায় বলা হল, অনধিক ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। এটা এক টাকা থেকে শুরু…। তাই আমরা (পুলিশ) একবারে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগের দিকে না গিয়ে ধাপে ধাপে এবং জানাতে চাই-বলতে চাই যে, এখন কিন্তু শক্ত আইন এত টাকা জরিমানা হবে।”
এক প্রশ্নে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “নতুন আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।”
ট্রাফিক আইন মেনে চলতে অনেক পুলিশ সদস্যেরও রয়েছে অনীহা
সফটওয়্যার আপডেট হয়নি ট্রাফিক পুলিশের
ট্রাফিক আইনের বেশিরভাগ মামলায় চালকের কাগজপত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে জরিমানার স্লিপ প্রিন্ট করে দেয় পুলিশ। পয়েন্ট অব সেল (পস) মেশিনের সঙ্গে আইনের সঙ্গতি রেখে সফটওয়্যার আপডেটের কাজ এখনও হয়নি বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
ডিএমপির ট্রাফিক দক্ষিণের যুগ্ম-কমিশনার রাজ্জাক এ বিষয়ে বলেন, ”বর্তমান পস মেশিনের সফটওয়্যারে আগের আইনটি সেট করা। নতুন আইনটি সফটওয়্যারে সেট করতে এক মাসের মতো সময় লাগবে। যতদিন সফটওয়ার পদ্ধতিতে না যাব, ততদিন ম্যানুয়্যাল পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হবে।”
চালক-যাত্রীর মিশ্র প্রতিক্রিয়া
নতুন আইন নিয়ে চালক, যাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
শাহবাগ মোড়ে বাসের অপেক্ষায় থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, “নতুন আইন তো যাত্রীদের কল্যাণেই। আমার মনে হয়, এটা সবাই মানলে রাস্তা আগের চেয়ে ভালো হবে।”
তিনি বলেন, ”আমরাতো চাই সড়ক নিরাপদ হোক। সেজন্য নতুন আইন বাস্তবায়নের আগে সচেতনতাও তৈরি করা জরুরি, যাতে সবাই আইনটা জানতে পারে।”
আইন বাস্তবায়নের পথ ধরে সড়কের শৃঙ্খলা অনেকটা ফিরতে পারে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তফা মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, “আইন হইছে ভালো কথা, কিন্তু আইনের বাস্তবায়নটা তো থাকতে হবে। ঠিকঠাক মতো বাস্তবায়ন হলে যাত্রী, চালক, হেলপার সবাই মানতে চেষ্টা করবে। তখন এমনিই শৃঙ্খলা আসবে।”
দেওয়ান পরিবহনের একজন চালক বলেন, “আমি মনে করি, নতুন আইন ভালোই হইছে, সড়কে নিরাপদ অবস্থা ফিরা আইলেই ভালো।”
তবে আইনে শাস্তির বিধান নিয়ে আপত্তির কথা জানান ট্রাস্ট পরিবহনের চালক আবদুল হক।
তিনি বলেন, “চালক দেইখা কি আমাগো প্রাণের দাম নাই? কেউ কি ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট ঘটায়? এটা ঠিক হয় নাই। এতো শাস্তি কেন দিবো? বাতাসের ব্রেক, এটাতো ফেল হইতেই পারে, এইটা কি আমরা ইচ্ছা করে করি?”
নতুন সড়ক আইনের পরিক্রমা
গত বছর ঢাকায় বাসচাপায় দুই ছাত্র-ছাত্রীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে আগের আইন কঠোর করে এই আইনটি করা হয়েছিল।
এই আইন অনুযায়ী, মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা নিহত হলে এ সংক্রান্ত অপরাধ দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর এ সংক্রান্ত বিধান অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
তবে দণ্ডবিধির ৩০৪বি ধারাতে যা-ই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হলে চালক সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
আইনের ১১৪ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৯৮) প্রযোজ্য হবে।
গত বছর ৮ অক্টোবর ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ এর গেজেট জারি করা হলেও তার কার্যকারিতা এত দিন ঝুলে ছিলে। এ নিয়ে আদালতে একটি রিট আবেদনও হয়েছিল।
আইনটি প্রণয়নের পর থেকে তার প্রবল বিরোধিতা করে আসছিল পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনার মামলায় নতুন আইনে শাস্তির মাত্রা ‘অযৌক্তিক’ বেশি।
এরপর গত ২৫ সেপ্টেম্বর পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইন সংশোধনের সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন।
তবে পরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এরপরই আইনটি কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ হয়।