# সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন # সন্ধ্যা ৫টা ৫৫ মিনিটে আগুন লাগে। # ভর্তি ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ রোগী। # আগুনে কেউ হতাহত হয়নি
# পাশের একটি হাসপাতাল জানায়, সোহরাওয়ার্দী থেকে এক শিশুকে মৃত অবস্থায় সেখানে আনা হয় ।
আবদুস সালামের (৭০) কিডনির সমস্যা। আগামী রোববার অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা। হাসপাতালে আগুন লাগায় সালামকে টেনে বের করেছেন তাঁর মেয়ে শিল্পী আক্তার। প্রস্রাবের ব্যাগ ধরে বাবাকে নিয়ে হাঁটছিলেন শিল্পী। পেছন থেকে সমানে তাড়া আসছে ‘সরেন সরেন, অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার পথ করে দেন।’ কয়েক কদম পথ, কিন্তু সালাম হাঁটতেও পারছিলেন না। আর সোমবার অস্ত্রোপচার হওয়া রোগী আবদুল মজিদকে (৩৮) কোনোরকমে বিছানাসহ টেনে হাসপাতাল থেকে বের করে সামনের রাস্তায় আনতে পেরেছেন স্বজনেরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগলে এ রকম ভয়াবহ অবস্থায় পড়েন রোগী ও তাঁর স্বজনেরা। হাসপাতালের ভেতর থেকে রোগীদের কোনোরকমে বের করে সামনের মাঠে, রাস্তায় বসিয়ে বা শুইয়ে রাখা হয়। এদের মধ্যে নবজাতক ছাড়াও ছিলেন মুমূর্ষু, বৃদ্ধ ও সদ্য অস্ত্রোপচার হওয়া রোগী। তাঁদের সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বিনা ভাড়ায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, তাৎক্ষণিক স্থানান্তরে অস্ত্রোপচারের রোগীদের সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। অনেক রোগীরই হাঁটা বারণ ছিল। তাদেরও বের হতে হয়েছে। ধোঁয়া ও আতঙ্কেও অনেকে ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, ভর্তি থাকা প্রায় ১ হাজার ২০০ রোগীর কেউ আগুনে হতাহত হননি। তবে পাশের বেসরকারি কেয়ার হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে মৃত অবস্থায় একটি শিশুকে ওই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। যদিও সোহরাওয়ার্দী কর্তৃপক্ষ তা নিশ্চিত করেনিগতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সামনের মাঠে ও রাস্তায় অসংখ্য রোগী। তাঁদের অন্য হাসপাতালে নিতে ছোটাছুটি করছেন অ্যাম্বুলেন্সগুলোর চালক, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও স্বজনেরা। চারদিক থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, পুলিশের বাঁশি, স্বজন ও সাহায্য করতে আসা মানুষদের হইচইয়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা।
রাত সাড়ে ১০টায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে আগুনের বিষয়ে জানানো হয়। সেখানে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, স্বাস্থ্যসচিব (শিক্ষা) জি এম সালেহউদ্দীনসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ও ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে স্বাস্থ্যসচিব বলেন, সন্ধ্যা ৫টা ৫৫ মিনিটে আগুন লাগে। আগুন শুরু হয় তিনতলায় শিশু ওয়ার্ড থেকে। এরপর খুব দ্রুততার সঙ্গে এগারো শর বেশি রোগীকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে এর আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছিল, হাসপাতালের নিচতলার গুদামঘরে (স্টোর) আগুনের সূত্রপাত। সেখান থেকে ধোঁয়ায় পুরো হাসপাতাল আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাদের ১৬টি ইউনিট চেষ্টা করে রাত সাড়ে নয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের ভিন্ন বক্তব্য সম্বন্ধে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে ফায়ার ব্রিগেডের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ বলেন, ‘আমরা জানি, আগুন নিচ থেকে ওপরে যায়। স্টোরটা নিচে আর শিশু ওয়ার্ডটা ওপরে (তিনতলায়)। সেই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা কথা বলেছি। এখন কোথা থেকে আগুন লেগেছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’
এর আগে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ১২ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝামাঝি জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ওই জায়গায় একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কক্ষ আছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে নিচতলা পর্যন্ত ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতাল বন্ধ হয়নি, জরুরি বিভাগ চালু হয়ে গেছে।
রোগীরা নিরাপদে?
আগুন লাগার পরপরই অনেকে অন্য হাসপাতালে চলে যান। বিপাকে পড়েন অতি অসুস্থ ও সহায়-সংগতিহীনেরা। পরে তাঁদের অনেককেই বিনা ভাড়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যান অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা। অনেকেই হাসপাতাল চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।
এঁদের একজন যশোরের রোকেয়া বেগমের লিভারে পানি জমেছে। ১০ দিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভ্যানচালক স্বামী আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় তাঁদের কেউ নেই। বারান্দায় থাকবেন, তবু হাসপাতাল ছাড়ছেন না।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ নিয়ে গতকাল দুপুরে ভর্তি হওয়া রোগী সুরাইয়া বেগমকে স্বজনেরা হাসপাতালের সামনে শুইয়ে রেখেছিলেন। তাঁর চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই আগুন লাগে। শুধু স্যালাইন লাগানো হয়েছে তখন। কোথায় যাবেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁর স্বজনেরা।
খুলনার শেখ নজরুল ইসলামের পায়ের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গিয়েছিল দুই সপ্তাহ আগে। শারীরিক অন্যান্য সমস্যার জন্য পায়ের চিকিৎসা শুরু হয়নি। তাঁর ভাগনে রাইসুল ইসলাম জানান, তাঁদের অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো সংগতি নেই। তাঁরা অপেক্ষায় আছেন কখন আবার হাসপাতাল চালু হবে।
বৃদ্ধা কুলসুম আক্তারের কোমরের জোড়া ভেঙে গেছে। মানিকগঞ্জ থেকে আসা এই নারীর সঙ্গে হাসপাতালে ঢোকার মুখে ফুটপাতে বসে ছিলেন তাঁর নাতনি শিল্পী বেগম। শিল্পী বলেন, নিচতলা থেকে বিছানার ফোম ধরে কুলসুমকে কোনোরকমে বাইরে আনা হয়েছে।
হাসপাতালের সামনের মাঠে হুইলচেয়ারে অসহায় হয়ে বসে ছিলেন যশোরের গণেশ সাহা। সঙ্গের লোক গেছেন গাড়ি খুঁজতে। উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন হাসপাতালে নেবে আমায়?’
প্রথমে আইসিইউতে থাকা রোগীদের ও পর্যায়ক্রমে জরুরি রোগীদের অন্যান্য হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান হাসপাতাল–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগুন লাগার পরপরই প্রথমে রোগীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছোটেন। পরিস্থিতি সামলাতে ঢাকা মেডিকেলে রোগের ধরন অনুসারে রোগীদের সরাসরি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনো ভর্তির ঝামেলায় না গিয়ে। ঢাকা মেডিকেলে শতাধিক রোগী ভর্তি করা হয়।
ঢাকা মেডিকেলে ভিড়ের কারণে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাইকে রোগীদের মুগদা ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার অনুরোধ জানায়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। সবাইকেই নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়েছে। আশপাশের সব হাসপাতালকে বলে দেওয়া হয়েছে রোগী নেওয়ার জন্য।
এক শিশু মৃত্যুর খবর
হাসপাতালে আগুন লাগার কারণে সেখানে ভর্তি এক থেকে দেড় বছর বয়সী একটি শিশু মারা গেছে বলে পাশের বেসরকারি কেয়ার হাসপাতাল থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।
কেয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ফেরদৌসি এ পূর্ণা রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার পরপর একটা বাচ্চাকে তার পরিবার কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। সোহরাওয়ার্দীতে তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখা হয়েছিল বলে স্বজনেরা জানান। আগুন লাগার পরপর তারা অক্সিজেন খুলে শিশুটিকে নিয়ে দৌড়ে কেয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এসে চিৎকার করছিল অক্সিজেন মাস্ক লাগাতে। তবে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, শিশুটি ততক্ষণে মারা গেছে। তখন পরিবারের লোকজন কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।
কেয়ার হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, মৃত শিশুটিকে কোলে নিয়ে মা ঘণ্টাখানেক এ হাসপাতালের সামনে বসে কান্নাকাটি করেন। তাঁদের বাড়ি মাদারীপুরে।
শিশুটিকে যেহেতু কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি, তাই নাম–ঠিকানাও রাখা হয়নি বলে কেয়ার হাসপাতাল থেকে জানানো হয়। তবে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এমন ঘটনার কথা গতকাল রাত পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি।