দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ড। পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে একঝাঁক স্থানীয় চাঁদাবাজ নেমে পড়েছে মাঠে। নিজেদের মধ্যে হানাহানির কৌশল বদল করে এলাকা ভাগ করে নিয়েছে এই সন্ত্রাসীরা। গত দেড় মাসে এমন ২০ জন স্থানীয় চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরা দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি করছিল।
এমনকি নিজের দলে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় খিলগাঁওয়ে স্থানীয় এক চাঁদাবাজকে হত্যাও করা হয়েছে। হঠাৎ করে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এই বেপরোয়া আচরণ ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। নেপথ্য কারণ খুঁজতে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের এই বেপরোয়া আচরণের কারণ খুঁজতে গিয়ে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমত, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের উসকানি দিচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী কিন্তু বাংলাদেশি পাসপোর্টও ব্যববহার করে না। তারা যে দেশে অবস্থান করছে, সে দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদার অর্থ ঐ দেশে চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাদের অর্থের বিনিময়ে হাত করে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে এসব সন্ত্রাসী। অনেকে ইতিমধ্যে সরকারি দলে যোগও দিয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেফতার করতে গেলে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়। এতে করে সুযোগ নিচ্ছে এসব সন্ত্রাসীর সহযোগীরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সন্ত্রাসী যত বড়ই হোক, তাতে কিছুই যায়-আসে না। আমরাও সক্রিয় আছি। তারা মাথাচাড়া দেওয়ার আগে আমরা এদের নির্মূল করব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
আরেক জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলাপকালে বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, সামনে আওয়ামী লীগের মূল কমিটি ছাড়াও সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় থানা ও ওয়ার্ড কমিটি হতে যাচ্ছে। সেখানে কমিটিতে ঢুকতে অনেক সন্ত্রাসী ইতিমধ্যে দলীয় কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানও করতে দেখা গেছে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগীদের। দলে ঢুকতে সিনিয়র নেতাদের হাত করতেও তাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এসব সন্ত্রাসীকে নিয়ে রিপোর্টও তৈরি করছে গোয়েন্দারা।’
জানতে চাইলে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা যত কৌশলই নিক, আমরাও সেভাবেই তাদের মোকাবিলা করব। যে সন্ত্রাসীই হোক, আমাদের নেটওয়ার্কে আসবেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্ধশত বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিক। বর্তমানে বিদেশে পালিয়ে আছে। ইতিমধ্যে অর্ধশত নেতাকর্মী জড়ো করে শাহজাহানপুর-খিলগাঁও এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের কাছে তার ফোনও আসতে শুরু করেছে। ইউরোপের নম্বর দিয়ে ফোনগুলো আসছে। দাবি করছে বড় অঙ্কের চাঁদা। না দিলে যথারীতি হত্যার হুমকি দিচ্ছে সে। শুধু ব্যবসায়ী নয়, স্থানীয় চাঁদাবাজরাও ভয়ে আছে। তার দলে কাজ না করলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। কাউসার নামে একজনকে ইতিমধ্যে খুনও করেছে। আরেক জনকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তার দলের সন্ত্রাসীরা।
আরও পড়ুন: ভ্যাকসিন পেতে প্রথম সারিতে থাকবে বাংলাদেশ: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
একইভাবে মোহাম্মদপুরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদেশে পালিয়ে থাকা একজন সন্ত্রাসী। মালিবাগের নিয়ন্ত্রণ আছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের। বর্তমানে গ্রেফতার হওয়া ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গে সখ্য ছিল জিসানের। গুলশান, বনানী, মহাখালীর নিয়ন্ত্রণ ইমাম হোসেনের। পল্লবীর নিয়ন্ত্রণ মুক্তারের। আর মিরপুর, গাবতলী ও দারুস সালামের নিয়ন্ত্রণ বিদেশে পালিয়ে থাকা আরেক সন্ত্রাসীর। কাশিমপুর কারাগার থেকেই কাফরুল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে কিলার আব্বাস। বিদেশে পালিয়ে থাকা টোকাই সাগরের সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণে উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকা। পুরান ঢাকার এখনো নিয়ন্ত্রক র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত ডাকাত শহীদের সহযোগীদের। ধানমন্ডি নিয়ন্ত্রণ করে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা সন্ত্রাসী কারাগারে থাকা সানজিদুল ইসলাম ইমন। বর্তমানে ভারতে অবস্থান করা লেদার লিটন নিয়ন্ত্রণ করছে লালবাগ-হাজারীবাগ এলাকা। মগবাজার ও রমনা এলাকা এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের ক্যাডাররা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরাও টের পেয়েছি কিছুদিন ধরে সন্ত্রাসীরা তাদের আনাগোনা বাড়িয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, দিনের পর দিন অনেক ওয়ার্ড কমিশনারও ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জানতে চাইলে তারা অস্বীকার করেন। তারা তো জানেন কারা সন্ত্রাসী। পুলিশ-জনতা যদি একসঙ্গে কাজ না করে, এদের নির্মূল সম্ভব নয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন বলেন, ‘কেউ কেউ পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। আমরাও সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি। তাদের সেই চেষ্টা সফল হবে না।’ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘আমরা কিন্তু তাদের তৎপরতা বুঝতে পেরে অভিযানও শুরু করেছি। গত দেড় মাসে ২০ জনকে গ্রেফতারও করেছি। গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।