শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গাড়ি বহরের একটি বাস হঠাৎ গিয়ে ধাক্কা খায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে, আর কেউ গুরুতর আহত না হলেও কনুই থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শিক্ষিকা সৈয়দা ফাহিমা বেগমের।
মঙ্গলবার দুপুরে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাথালিয়া এলাকায় এই দুর্ঘটনার পর বিকালেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে তাকে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিটিউটে।
ওই দিনই সেখানে অস্ত্রোপচার করে জোড়া লাগানো হয়েছে ফাহিমার বাঁ হাতের বিচ্ছিন্ন অংশ, সেখানে রক্ত চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
উৎসব-আনন্দের যাত্রায় স্বজনের এই মর্মান্তিক পরিণতিতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন ঢাকার খ্যাতনামা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা ফাহিমার ছেলে, স্বামীসহ স্বজন, শিক্ষার্থী ও তার পরিচিতজনরা।
বুধবার ওই হাসপাতালের চারতলায় আইসিইউর সামনে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অপেক্ষায় আছেন তাদের অনেকেই।
এই শিক্ষিকার স্বামী-ছেলে, বড় ভাই, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ছাড়াও সেখানে ছিলেন তার একদল ছাত্র, সহকর্মী শিক্ষকরাও। সবার একটাই প্রশ্ন, কীভাবে কী হয়ে গেল?ঘটনার বিবরণে উইলসের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ মুহাম্মদ মাহিদ বলেন, “চোখের সামনে একটা জোরে ধাক্কা লাগার পর সুস্থ-সবল শরীর থেকে একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমি ওই বাসেই ছিলাম, ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন ম্যাম, এ অবস্থায় দৌঁড়ে গিয়ে ম্যামকে ধরলাম। দেখা যাচ্ছে হাতের হাড়গোড় সব বের হয়ে গেছে, রক্তে ভরে গেছে।
“বাঁ হাত কনুইয়ের পর ছিঁড়ে পড়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে অনেকে তখন অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু আমি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেছি, কারণ ম্যামকে বাঁচাতে হবে।”
টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে চারটি মিনিবাস ও দুটি মাইক্রোবাসে করে যাচ্ছিলেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ১২৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারী। শিক্ষিকা ফাহিমার বাসেই ছিলেন মাহিদ।
তিনি বলেন, “ড্রাইভার আমাদের গাড়িটা তখন খুব গতিতে চালাচ্ছিল। এই গতিই হয়ত দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।”
দুর্ঘটনার খবর শুনে রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন ফাহিমার বড় ভাই সৈয়দ জাহিদুল করিম।
ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার জাহিদুল আইসিইউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “ঘটনা এতটা মর্মান্তিক হবে তা কল্পনাও করিনি। এখন চিকিৎসকরা জানেন এখানে এত মারাত্মক রোগীর চিকিৎসা কতটুকু হবে। আমরা প্রয়োজনে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করার জন্য প্রস্তুত আছি, যদি এখানের চিকিৎসকরা পাঠাতে চান।”
ফাহিমার স্বামী সৈয়দ শফিকুল ইসলাম পুলিশের বিশেষ শাখার জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন। এই দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বিন্তু খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছেন। আর ছোট ছেলে সৈয়দ ফাহিমুল ইসলাম ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
মায়ের এই দুর্ঘটনার পর থেকে হাসপাতালেই আছেন ফাহিমুল। সকালে তার একদল বন্ধু আসেন হাসপাতালে।
তাদের ভিড়ের মধ্যেই ফাহিমুল বলেন, “কীভাবে কী হয়ে গেল, তা তো ভাবতেও পারছিলাম না। এটাই বুঝি আমাদের কপালে ছিল!”
তিনি বলেন, “আমি আইসিইউতে গিয়ে আম্মুকে দেখেছি, চোখ খুলে তাকিয়েছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, আম্মুর জোড়া লাগানো হাতের অংশে ব্লাড সার্কুলেশন হচ্ছে। ডাক্তাররাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করি, বেস্ট ট্রাইয়ের মাধ্যমে আম্মু সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
ফাহিমার সহকর্মী উইলস লিটল ফ্লাওয়ারেরই শিক্ষিকা নূর জাহান। শান্তিনগরে পাশাপাশিই তাদের বাসা। ফাহিমার ছোট ছেলে ও নূর জাহানের ছেলে স্কুলে একই সাথে পড়েছেন।
সহকর্মীর দুর্ঘটনার কথা শুনে হতবিহবল নূর জাহানও। তিনি স্বামী বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন ফাহিমার স্বামী-ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য।
মনিরুজ্জামান বলেন, “তারা অনেক ভালো মানুষ। আমার স্ত্রী ও ফাহিমা ম্যামের মধ্যে সখ্য অনেক দিনের। আমরা পারিবারিভাবেও একজন আরেকজনের সুখে-দুঃখে আছি। উনার এই দুর্ঘটনাতে আমরা অনেক কষ্ট পাচ্ছি।”
আইসিইউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন বলেন, “মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণে আমরা ব্যথিত। এটা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট ও বেদনার।”
সহকর্মীর মারাত্মক দুর্ঘটনার পর বুধবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
ঢাকার নামি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকাল ৮টা থেকে বেলা পৌনে ১২টা এবং দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা- দুই শিফটে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।
এদিকে শিক্ষিকা ফাহিমার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতির খবর দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন দুপুরে বলেন, “আজকে সকালে আমরা কয়েকবার দেখেছি। এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভালো বলা যায়, খারাপ না। তবে অন্য কোনো কিছু বলা যাবে না, ৭২ ঘণ্টা না যাওয়া পর্যন্ত।
“আগামীকাল সকালে আমরা মেডিকেল বোর্ডের সবাই মিলে বসব। তারপর দেখে ডিসিশন নেব কী করা যায়।”
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “দেখা যাচ্ছে হাত জোড়া লাগানো অংশে ব্লাড সার্কুলেশন হচ্ছে।”