পরিচয় দিয়েছিলেন বীরেশ চন্দ্র সাহার সন্তান হিসেবে। দাখিল করেছিলেন জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও সিটি করপোরেশনের নাগরিক সনদপত্র। এসব জাল কাগজপত্র দিয়েই সাভারের গান্ধারীয়া মৌজার কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি অবমুক্তির রায় হাসিল করে নেন এক জালিয়াত চক্র।
ভয়াবহ এই জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে উচ্চ আদালতে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে হাসিল করা ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সম্পত্তি অবমুক্তির দুটি রায় বাতিল করে দিয়েছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জালিয়াতকারি চক্রের হোতা মাধব চন্দ্র সাহাকে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
হাইকোর্ট বলেছে, আবেদনকারীদ্বয় (মাধব ও রোহী) বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দারের সন্তান হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের পারিবারিক ছবি আদালতে দাখিল করতেন। বাবা-মায়ের নামের ভোটার তালিকা উপস্থাপন করতেন। বাবা-মা কবে মারা গেছেন, কোথায় দাহ করা হয়েছে বলতে পারতেন। তাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের নাম, ঠিকানা বলতে পারতেন। নথি পর্যালোচনায় এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, আবেদনকারীদ্বয় বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দারের সন্তান হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। জাল কাগজ দাখিল করে এরা আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এই জালিয়াতি ও প্রতারক চক্র জাতির শত্রু।
বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দেন। গত বছর দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিকে নথিপত্র সঠিকভাবে যাচাই না করে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি অবমুক্তির রায় জালিয়াত চক্রের অনুকূলে দেওয়ায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ এবং আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারকের সমালোচনা করেছে হাইকোর্ট।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, এটা স্বতঃসিদ্ধ যেকোনো মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কারণসমূহ যথেষ্ট যুক্তিসম্পন্ন হতে হবে। যুক্তিহীন রায় বিচার বিভাগকে জনগণের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ করে। সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কারণগুলো যুক্তিসম্মত না হলে সে সিদ্ধান্ত বা রায় জনমনে আস্তাহীনতার সৃষ্টি করে। আর বিচারকের প্রজ্ঞা ও সততা ছাড়া মানসম্মত বিচার ব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না।
আদালত বলেছে, মাধব ও রোহী চন্দ্র সাহা নিজেদেরকে ক্ষেত্র মোহনের নাতি ও বীরেশ চন্দ্র সাহার সন্তান দাবি করে মূল মালিকের উত্তরাধিকারী হিসাবে সম্পত্তি ফেরত পেতে মামলা করেন। কিন্তু এদের মালিকানার বিষয়টি যাচাইয়ের সুযোগ ছিল ট্রাইব্যুনালের। কিন্তু সেটা না করে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিকত্ব সনদ বিবেচনা করে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি জালিয়াত চক্রকে দিয়ে দেন তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
রায়ের কপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর নির্দেশ
হাইকোর্ট বলেছে, জনগণের সম্পত্তি দেখভালের সর্বশেষ স্তরে জনগণ বিচারকদের উপর আস্থা রেখেছেন। বিচারকদের বিশাল গুরুদায়িত্ব হলো জনগণের সম্পত্তি যেন জোচ্চোর, ঠক, বাটপার এবং জালিয়াত চক্র গ্রাস করতে না পারে। সেজন্য রায়ের এই অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রেরণ করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হলো। যাতে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত উদ্যোগে নালিশি অর্পিত সম্পত্তিসহ লাখ লাখ কোটি টাকার রাষ্ট্র তথা জনগণের সম্পত্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মত লুটেরা বাহিনীর হাত হতে রক্ষা করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেন।
সাভারের গান্ধারীয়ায় জমি নিয়ে এই জালিয়াতি
ঢাকা জেলার সাভারের গান্ধারীয়া মৌজার ২ নং খতিয়ানের এস.এ ৩০ নং দাগের ১৫ দশমিক ২ একর, ৭২ নং দাগের শূন্য দশমিক ১৬ একর, ৭৮ নং দাগের শূন্য দশমিক ৫৬ একরসহ মোট ১৫ দশমিক ৭৪ একর ভূমির মালিক বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দার। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান। ফলশ্রুতিতে নালিশি সম্পত্তি সেনসাস লিস্ট অনুযায়ী শত্রু সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে নালিশি সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি তথা ভেস্টেড প্রপার্টি (ভি.পি) তালিকাভুক্ত হয়। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ২০১২ সালে মাধব চন্দ্র সাহা পোদ্দার ও রোহী চন্দ্র সাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার এক হাজার ৫৫৬ শতাংশ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে এবং প্রকাশিত গেজেটে ‘ক’ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্তির জন্য ঢাকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মামলা (মামলা নং :৪৭৯/২০১২) দায়ের করেন। ২০১৬ সালে ২৫ অক্টোবর সাভারের সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এক রায়ে বাদি পক্ষের আবেদন মঞ্জুর করেন। নালিশি সম্পত্তি অবমুক্তির আদেশ দেয়। রায়ে বলা হয়, মামলার বাদীরা যে বীরেশ চন্দ্র সাহার ওয়ারিশ নয় সেই মর্মে কোনো প্রমাণ আদালতে দাখিলে বিবাদীরা ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া বাদিদের দাখিল করা নথি (জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক নাগরিক সনদপত্র) যে জাল তাও প্রমাণ করতে পারেনি। সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে বীরেশ চন্দ্র সাহার সম্পত্তি অবৈধভাবে ভিপি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাদিরা তার বৈধ ওয়ারিশ।
এই রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল (আপিল নং: ২০/২০১৭) করেন ঢাকার জেলা প্রশাসক। অর্পিত সম্পত্তি আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং ঢাকার জেলা জজ ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর আপিল খারিজ করে সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের রায় বহাল রাখে। পরে এই রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন সাভার থানা অসহায় পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। রিটে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় ও ডিক্রি অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানানো হয়। ওই রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত বছর হাইকোর্ট দুটি ট্রাইব্যুনালে রায় বাতিল করে দেয়।
ট্রাইব্যুনালে মামলাকারীরা ভুয়া
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট মৌজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক দাবি করা মাধব ও রোহী পৌরসভার হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদান করেন নাই। বিদ্যুৎ বিলের কোনো কাগজ নাই। কোনো সরকারি খাজনা প্রদানের রশিদ নাই। সম্পত্তির মালিককে স্থানীয় সাভার থানার কেউ চিনে না। স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি থেকে কোনো সনদ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। একইসঙ্গে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত রেখে দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর কেন নীরব ছিলেন সেই বিষয়ে কোনো বক্তব্য নাই। নিজেদের সম্পত্তিতে না থেকে মিরপুরে কালসিতে ভাড়া বাসায় থাকেন সেই বাসার হোল্ডিং নাম্বারও প্রদান করেন নাই।
অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালে মামলাকারী যে প্রকৃতপক্ষে ভুয়া এবং জালিয়াতকারী তা দিনের আলোর মত প্রমাণিত সত্য। এমনকি মাধব চন্দ্র মূল মামলার হলফনামায় যেসব তথ্য দিয়েছেন তা আদালতের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
রায়ে বলা হয়েছে, মেহনতি কৃষক-শ্রমিকের রক্ত পানি করা অর্থ কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী লুটেরা বাহিনীর মত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। জনগণের বেতনভোগী এসব দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচারক, বিচারপতিদের জনগণের আদালতে দাঁড় করানোর এখনই সময়। কেবলমাত্র তাহলেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
গ্রাসের হাত থেকে রক্ষায় পার্ক
২০১১ সালে ঢাকার ভিপি শাখার দুজন সার্ভেয়ারের দেওয়া প্রতিবেদনে এই জমি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করে বলা হয়, সরকার হেফাজাতীয় ভিপি তালিকা ভুক্ত সম্পত্তি যে কোনো সময় বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই জমির পাশেই একটি প্রাইভেট হাউজিং কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যার নাম ‘গান্ধারীয় ওশেন সিটি’ । এই ভিপি সম্পত্তির চারপাশে তাদের সাইনবোর্ড রয়েছে। যেকোনো সময় এই সরকারি সম্পত্তি হাউজিং কোম্পানির গ্রাস করার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই বিষয়টি তুলে ধরে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, মজার ব্যাপার হলো ওই সার্ভেয়ারদ্বয়ের আশংকা বাস্তবে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। সার্ভেয়ারদ্বয় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের এক বছর পর ২০১২ সালে ক্ষমতাশালী এক অশুভ চক্র জনগণের কয়েক হাজার কোটি টাকার মূল্যবান সম্পত্তিটি লুট করার জন্য বীরেন্দ্র চন্দ্র সাহা পোদ্দারের দুইজন ছেলে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। কিছু জাল কাগজ সৃজন করে তাদের দিয়ে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। এরপর সবকিছুই ইতিহাস। দেশের জনগণ অবাক হয়ে দেখলো জনগণের সম্পত্তি কিভাবে সরকারি অফিস আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় লুট করলো। এ কারণে পুনরায় জাল দলিল সৃজন করে এই নালিশি সম্পত্তি গ্রাস করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে মূল মালিক ‘ক্ষেত্র মোহন’ এর নামে সাভার অঞ্চলের শিশু কিশোরদের জন্য একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করতে ঢাকার ডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হলো।