তিন কিশোর খেলনা পিস্তল নিয়ে কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংক লুট করতে এলেও তাদের আচরণ ছিল পেশাদার ডাকাতের মতো। ব্যাংকের ভেতরে থাকা লোকজন আসল পিস্তল ভেবে প্রাণভয়ে কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে আসেননি।
আত্মসমর্পণের পর ওরা অস্ত্রগুলো পুলিশের হাতে জমা দেওয়ার পর খেলনা পিস্তলের বিষয়টি জানাজানি হয়।
বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের রূপালী ব্যাংক ডাকাতির সময় ভেতরে ডাকাতদের হাতে ৬ জন গ্রাহক, এক শিশু ও ব্যাংকের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ডাকাতরা আত্মসমর্পণ করলে মুক্তি পান জিম্মিরা।
জিম্মি থাকা গ্রাহকদের একজন চুনকুটিয়ার বাসিন্দা বাবুল খান। পেশায় তিনি বাড়িঘর নির্মাণের কন্ট্রাকটরের কাজ করেন। শুক্রবার বিকালে তিনি জিম্মি অবস্থার বর্ণনা দেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
তিনি বলেন, বেলা পৌনে ২টার দিকে এক লাখ টাকা জমা করতে ব্যাংকে যাই। দুপুরের দিকে তেমন ভিড় ছিল না। আমিসহ মাত্র ৬ জন গ্রাহক। একজনের সঙ্গে ছোট একটা বাচ্চা। টাকাগুলো ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিয়েছি, এমন সময় তিনজন লোক ব্যাংকে ঢুকে পড়ে। সবার মুখমণ্ডল ঢাকা। এ সময় ভেতরে থাকা ব্যাংকের একজন গার্ড পা পিছলে মেঝেতে পড়ে যান। একজন তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেয়। সবাইকে চুপচাপ থাকতে বলে। এলার্ম বাজাতে নিষেধ করে।
বাবুল খান বলেন, এ সময় ভয় আর আতঙ্কে সবাই অস্থির হয়ে পড়েন। অনেকেই কান্নাকাটি করতে থাকেন। এরপর সবাইকে এক জায়গায় এনে ফ্লোরে বসিয়ে দেয়। সবার মোবাইল নিয়ে নেয়। এর পর সঙ্গে করে আনা ৩টি ব্যাগে ক্যাশ কাউন্টার থেকে ৫০ লাখ টাকার মতো ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে এসব ঘটে যায়।
বাবুল খান আরও বলেন, এদিকে ব্যাংক ডাকাতির বিষয়টি বাইরে জানাজানি হয়ে গেলে মাইকে ঘোষণা করা হয়। এলাকাবাসী ব্যাংক ঘিরে ফেলে বাইরে থেকে ব্যাংকের গেট তালাবদ্ধ করে দেন। এতে ডাকাতরা ব্যাংকের ভেতর আটকা পড়ে। তবে এ সময় ওদের বিচলিত হতে দেখা যায়নি। এরপর ঘটনাস্থলে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা উপস্থিত হলেও ওরা নির্বিঘ্ন ছিল। ওরা বলছিল পুলিশ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তবে যখন সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, তখন ওরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। কাঁধ থেকে টাকার ব্যাগ নামিয়ে মেঝেতে রাখে।
তিনি বলেন, এ সময় ওরা অস্থির হয়ে পড়ে। এদিকে ব্যাংকের একজন অফিসারের মোবাইলে ফোন এলে সেই ফোন দিয়ে ওরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে। এভাবে কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। এ সময় দুজন গ্রাহক টয়লেট ব্যবহার করতে চাইলে ওরা অস্ত্রের মুখে তাদের অনুমতি দিয়েছে। একজন নারী কর্মকর্তা অনেক কান্নাকাটি করছিল। তাকেও তারা ক্ষতি করবে না বলে আশ্বস্ত করে কান্না থামাতে বলে। একপর্যায়ে একটি ব্যাগে ১৫ লাখ টাকা ভরে সেটা নিয়ে ওরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
বাবুল খান বলেন, আমরা ওদের চেহারা দেখতে পারিনি। তবে কণ্ঠস্বর ও শারীরিক গঠন দেখে বুঝতে পারছিলাম এরা কিশোর বয়সের।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহমেদ মুঈদ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, এ ঘটনায় আমরা জিম্মি লোকজনের সেফটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অভিযান চালিয়েছি। আটকে পড়ার পর মোবাইলে ওদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা সময় নিয়েছি, নানাভাবে বুঝিয়ে ওদের কনভিন্স করেছি। ওদের দাবি আমরা জানতে চেয়েছি। ওরা ১৫ লাখ টাকা ও নিরাপদ প্রস্থান দাবি করে। আমরা রাজি হই। ওরা ১৫ লাখ টাকা ব্যাগে ভরে সঙ্গে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এ সময় ওই টাকা ও ওদের প্যান্টের পকেট থেকে আরও ৩ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। আত্মসমর্পণের পর তাদের গ্রেফতার করা হয়।
এসপি বলেন, ব্যাংক লুটের বিষয়টি পরিকল্পিত ছিল। গ্রেফতার ৩ জনের মধ্যে দুজনের বয়স ১৬। একজনের ২২। ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করা পিস্তলগুলো ফেক (খেলনা) ছিল। এদের দুজন ব্যাংকের আশপাশেই বসবাস করে। কাছাকাছি হওয়ায় ওরা এই ব্যাংকে টার্গেট করে।
তিনি বলেন, কিশোর অ্যাডভেঞ্চার ও ফ্যান্টাসি থেকে তারা এমনটা করেছে। এ ঘটনার আগে তারা বিভিন্ন মুভি ও অনলাইনে ভিডিও দেখেছে। জিজ্ঞাসাবাদে ওরা জানিয়েছে- একজন রোগীকে সাহায্য করতে ও আইফোন কিনতে তারা ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা করে। রোগীকে সহায়তা করার বিষয়টি আমরা এখনো যাচাই করতে পারিনি।
এদিকে রূপালী ব্যাংকে ডাকাতি চেষ্টার ঘটনায় শুক্রবার ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার তারেক মাহমুদ বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় গ্রেফতার হওয়া ৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, আসামিদের মধ্যে দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক। শুক্রবার তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের গাজীপুরে কিশোর সংশোধনালয়ে পাঠানো হয়েছে। অপর আসামি প্রাপ্তবয়স্ক (২২ বছর)। তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
ব্যাংকের ম্যানেজার শেখর মণ্ডল বলেন, ব্যাংকের সব টাকা গুনে দেখা হয়েছে। এক টাকাও খোয়া যায়নি। রোববার থেকে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলবে।