তুষার ধস আর ‘রকফলের’ ঝুঁকি নিয়ে ৯০ ডিগ্রি খাড়া গিরিপথ বেয়ে হিমালয়ের ২২ হাজার ৩৪৯ ফুট উচ্চতার আমা দাবলাম চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন চট্টগ্রামের তরুণ মো. বাবর আলী।
প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে তিনি মঙ্গলবার সকালে নেপালের ওই পর্বত চূড়ায় ওঠেন বলে জানান তার অভিযানের সমন্বয়ক ফারহান জামান।
তিনি বলেন, নেপালের ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়টি নামের অর্থ ‘মায়ের গলার হার’। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৩ মিনিটে শিখরে পৌঁছান বাবর।
“চূড়ায় আরোহণের পর বাবরের বেজক্যাম্পে ফিরতে প্রায় দেড় দিন লেগেছে। সেখান থেকে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে একটি গ্রামে পৌঁছান নেটওয়ার্কের জন্য। এরপর আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।”
আগামী ৯ নভেম্বর তার দেশে ফেরার কথা জানিয়ে ফারহান দাবি করেন, “এর আগে বাংলাদেশ থেকে কেউ এই অভিযানে সফল হয়নি। এর আগে এমএ মুহিত ভাই চেষ্টা করেছিলেন। কলকাতা থেকেও অনেকে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একজন সফল হইছিল। সে হিসেবে বাবর দ্বিতীয় বাংলাভাষী।”
হিমালয়ের আমা দাবলাম চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশি
চট্টগ্রামের এই তরুণ পেশায় চিকিৎসক হলেও তার ধ্যানজ্ঞান পর্বতারোহণ। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের একমাত্র পর্বতারোহণ ক্লাব ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান কার্যকরী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি।
বাবরের আমা দাবলাম অভিযানের কথা তুলে ধরে এক্সপেডিশনের সমন্বয়ক ফারহান বলেন, চলতি বছরের ৯ অক্টোবর বাবর নেপালের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। ১১ অক্টোবর অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় আবহাওয়া।
“বৈরী আবহাওয়ার কারণে কাঠমান্ডু থেকে নিয়মিত লুকলার বিমান বন্ধ হয়ে যায় ওই সময়। তাই পরদিন সড়ক পথে যাত্রা করেন বেজক্যাম্পের উদ্দেশে। কিছুটা পথ গাড়িতে এবং বাকি পথ পায়ে হেঁটে ১৯ অক্টোবর পৌঁছান আমা দাবলাম বেজক্যাম্পে।”
ফারহান বলেন, “যদি ফ্লাইট ধরতে পারত, তার ট্র্যাক করা লাগতো দুদিন। তারা যেহেতু ফ্লাইট পায়নি, তাই তার আরও অতিরিক্ত চারদিন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হইছে। আবার মাঝখানে ওর গাইড অসুস্থ হয়ে পড়ায় দুদিন নামচে বাজারে বিশ্রাম নিতে হইছিল।
“ক্যাম্পে পৌঁছে একদিন বিশ্রাম নিয়ে পরপর দুইদিন ক্যাম্প ১ ও ক্যাম্প ২ এ গিয়ে আবার বেজক্যাম্পে ফিরে আসেন বাবর। কারণ, পর্বত আরোহণ শুরু করার আগে স্বল্প অক্সিজেন থাকা আবহাওয়ায় শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এটা করতে হয়।”
হিমালয়ের আমা দাবলাম চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশি
বাবরের মূল যাত্রা ২৩ অক্টোবর ভোরে বেজক্যাম্প থেকে শুরু হয় জানিয়ে ফারহান বলেন, “২৫ অক্টোবর ভোরে তিনি পর্বতের চূড়ায় পা রাখেন। এর প্রায় দুদিন পরে ২৬ অক্টোবর বিকালে তিনি সুস্থ অবস্থায় বেজক্যাম্পে নেমে আসেন। এই পুরো পথে তার সাথে ছিলেন তার পর্বতারোহী বন্ধু ও গাইড বীরে তামাং।”
খাড়া ও ঢালু দেয়ালের জন্য এই পর্বত ‘হিমালয়ের ম্যাটারহর্ন’ নামেও পরিচিত এবং নেপালের এক রুপির ব্যাংক নোটে এই পর্বতের ছবি রয়েছে বলে জানান তিনি।
এই পর্বতে অভিযান কঠিন মন্তব্য করে ফারহান বলেন, “কারণ একটাই, এটা অনেক টেকনিক্যাল, মানে একদম ৮০-৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের খাড়া দেয়াল। নন-স্টপ পাথর পড়তে থাকে উপর থেকে, রকফল বলে আর কি। এছাড়া অনেক তুষার জমে। যেহেতু খাড়া ঢাল, সেহেতু একটু নড়লেই তুষার ধস হয়। সেই তুষার ধসে অনেকের প্রাণ যায়।”
নিজ খরচে বাবর এই অভিযান সম্পন্ন করেছেন এবং তার প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান ফারহান। তিনি বলেন, “যেহেতু নিজের খরচে গেছেন, সবথেকে লোয়েস্ট বিডারের সাথে গেছেন। যারা অনেক টাকা খরচ করে এক্সপিডিশনে যেতে পারেন, তাদের কাছে স্যাটেলাইট ফোন থাকে।
হিমালয়ের আমা দাবলাম চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশি
“আমরা যেহেতু মিনিমাম খরচে গিয়েছি, ওই সুবিধাটা ছিল না। স্যাটেলাইট ফোনে এক মিনিট কথা বলতে ৫০০ থেকে ৬০০ টকা চলে যায়। এত খরচ দিয়ে এক্সপিডিশন আমাদের জন্য মুশকিল আর কি।”
বাবরের প্রথম হিমালয় যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’ ক্লাব আয়োজিত ওই অভিযানে হিমালয়ের ৫ হাজার মিটার উচ্চতার এক পর্বতের চূড়ায় উঠেছিলেন। পর্বতারোহণ শুরুর আগে প্লাস্টিকের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে ৬৪ দিনে দেশের ৬৪ জেলা পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছিলেন।