হৃদয়ের দশ দিগন্তে আজ আলোর নাচন। যে আলোয় দুলে দুলে উঠছে আত্মার গহিনে লুকোনো ভালোবাসার কথা।
গোপন প্রিয়াকে আজ অকপটে বলা যায়, ‘ভালোবাসি, তোমাকেই ভালোবাসি’। কেননা, আজ ভালোবাসার দিন, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে।
ফাগুনের আগুন রাঙানো সকালের সূর্যের আলোয় আজ মিশে আছে নিভৃত হৃদয়ের বার্তা। আজ আকাশে-বাতাসে ভাসছে অনাদিকালের সেই আকুল আকাঙ্ক্ষা, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন/খুঁজি তারে আমি আপনায়/আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি/আমারি পিয়াসী বাসনায়। ’ কবি নজরুলের এই আবেগমথিত অনুভূতি আজ কোটি কোটি মানুষের অনুভূতি।
‘ভালোবাসা’- মাত্র চারটি অক্ষরে এই শব্দের গভীরতা আর ব্যাপকতা সীমাহীন। ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়/যুদ্ধ আসে, ভালোবেসে/মায়ের ছেলেরা চলে যায়’- কী প্রগাঢ় শক্তি আর বিষাদ এই ভালোবাসার। গ্রিক পুরাণের হেক্টর মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মনুষ্যত্বের প্রতি ভালোবাসার কারণে দাঁড়িয়ে ছিলেন দানবের মুখোমুখি। যুগে যুগে, কালে কালে ভালোবাসার টানে আকুল হয়েছে মানব-মানবী। অনাদিকাল থেকে হৃদয়ের প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা আর মমতা দিয়ে পরস্পরকে কাছে টেনেছে তারা। আবেগমথিত কণ্ঠে একে অন্যকে বলেছে, ‘জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি/তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি/যতো পাই তোমায় আরও ততো যাচি/যতো জানি ততো জানি নে। ’
ভালোবাসা এমন এক জিনিস- মানুষ ভালোবাসতে বাসতে একসময় নিজের চেয়ে অন্যকে বেশি ভালোবেসে ফেলে। এই অন্য মানুষটাই হয়ে ওঠে আরেক পৃথিবী। হয়তো এ কারণেই মানুষ প্রেমে পড়লে বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলে। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘সুরঞ্জনা/ ওইখানে যেওনাকো তুমি/ বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে/ ফিরে এসো সুরঞ্জনা/ নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে…’।
বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাসে আজ হারিয়ে যাবে প্রেমিকযুগল। সব আবেগ আর অনুভূতি দিয়ে প্রিয় মানুষটিকে বুঝিয়ে দেবে ভালোবাসার গভীরতা। মানব-মানবীর চিরকালের যে প্রেম তার জয়গান হবে চারদিকে। আজকের এই রাঙা সকাল, বিকেল বা সন্ধ্যাটা একসঙ্গে কাটিয়ে প্রেমিকযুগল গাইবে ভালোবাসার গান। অনেকের জন্য যেমন আজকের কোনো একটা সময় হবে ভালোবাসার প্রথম প্রহর, তেমনিভাবে অনেকে উদযাপন করবেন একসঙ্গে পথচলার কয়েক বছর।
আজকের দিনে সবকিছুতেই প্রাধান্য পাবে ভালোবাসার মানুষটির পছন্দ। তাই প্রিয় মানুষটি প্রিয় রং বা প্রিয় পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে উপস্থিত হবেন আরেকবার। তবে ভালোবাসার রং লাল বলে বেশির ভাগ যুগলই নিজেদের সাজাবেন লালে। নতুন করে একে অপরের প্রেমে পড়বেন। নিজেদের মতো করে কাটিয়ে দেবেন সারাটি দিন।
আজ ভালোবাসা দিবসে প্রেমিকযুগলের পদচারণায় মুখর থাকবে শহরের নানা পথ-প্রান্তর। দুজনে দুজনার হাত ধরে ঘুরবে একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত। কারণ, আজ নিজেদের মতো করে হারিয়ে যাওয়ার দিন। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ছবি-সেলফি তোলা চলবে। অনেক যুগল রিকশায় ঘুরে বেড়াবেন। অনেকে আবার বিভিন্ন উদ্যানে-পার্কে গাছের ছায়ায় বসে মন খুলে কথা বলবেন।
রাজধানীতে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ মেতে থাকবে ভালোবাসার উৎসবে। টিএসসি, শাহবাগ, চারুকলা, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরও থাকবে যুগলদের পদচারণায় মুখর। অনেকে আবার ধানমণ্ডি, বনানী, গুলশান, উত্তরার ফাস্টফুড ও কফিশপগুলোয় মিলিত হবেন। রাজধানীর শপিংমলের ফুডকোর্ট যেমন যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা সিটিতে চলবে খাওয়া-দাওয়া। অনেকে আবার একসঙ্গে সিনেমা দেখবেন। কেউ কেউ হয়তো প্রেয়সীকে নিয়ে একেবারেই নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর জন্য লং ড্রাইভে চলে যাবেন দূরে কোথাও।
অনেক প্রেমিকযুগল আবার ভালোবাসা দিবসকে বেছে নিয়েছেন বিয়ের দিন হিসেবে। তাই ভ্যালেন্টাইন ডে এখন বিয়ের দিন হিসেবেও জনপ্রিয়। দিনটিতে দুজন দুজনকে উপহার দেওয়ার প্রচলন আছে। আজ চকোলেট, পারফিউম, বই, প্রিয় পোশাক, আংটি, ঘড়ি, খেলনা উপহার হিসেবে দেয়া- নেওয়া চলবে। তবে সবচেয়ে বেশি দেওয়া-নেওয়া হবে রক্তগোলাপের। পাশাপাশি প্রেমবার্তা, শুভেচ্ছা কার্ড, ই-মেইল, মোবাইলে এসএমএস পাঠানো চলবে সমান তালে।
ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরনো এবং এ নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে। সময়টা ২৬৯ খ্রিস্টাব্দ। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক, যিনি একজন চিকিৎসকও ছিলেন। সেই সময় রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। রোমানরা একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছে।
যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রের বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু রাজ্যের লোকজন বিশেষ করে তরুণরা এতে উৎসাহী নয়। সম্রাট ধারণা করলেন, পুরুষরা বিয়ে করতে না পারলে যুদ্ধে যেতে রাজি হবে। তিনি তরুণদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু প্রেমিক তারুণ্য মন এমন নিয়ম মানতে চায় না। তাদের পাশে এগিয়ে এলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইন প্রেমাসক্ত তরুণ-তরুণীদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু একসময় ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন। তাকে জেলে নেওয়া হলো। দেশজুড়ে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই ভ্যালেন্টাইনকে জেলখানায় দেখতে যান। জেলারের একজন অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। চিকিৎসক ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির অন্ধত্ব দূর করলেন। একসময় হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়লেন তারা। ধর্মযাজক হয়েও নিয়ম ভেঙে প্রেম করা এবং বিয়ে করেন ভ্যালেন্টাইন। খবর যায় সম্রাটের কানে।
তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই তারিখটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের আজকের দিন ‘১৪ ফেব্রুয়ারি’। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইন তার প্রেয়সী এবং বধূকে যে চিঠিটি লেখেন তার শেষটায় লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’।
এরপর দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
আজ ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে নানারকম আয়োজন রয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিনটি উপলক্ষে প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।