হেফাজত ভেঙে দুই টুকরা হচ্ছে !

image-199078-1605410665

প্রতিষ্ঠার এক দশক পর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ঘিরে দেশের সর্ববৃহত্ ধর্মভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ভেঙে দুই টুকরা হয়ে যেতে পারে! কারণ সংগঠনের দুই গ্রুপের কোন্দল প্রকাশ্যে উঠে এসেছে।

জানা গেছে, হেফাজতের প্রয়াত আমির আল্লামা আহমদ শফিপন্থীরা কাউন্সিল বন্ধের আহবান জানিয়ে বলেছেন, অন্যথায় তারা আহমদ শফির খলিফাদের নিয়ে বিকল্প হেফাজতে ইসলাম গঠন করবেন। তবে হেফাজতের মূল অংশটি বলছে, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সংগঠনের মহাসচিব এই সম্মেলন ডেকেছেন।

২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মত আজ রবিবার হেফাজতের সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় সংগঠনের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সকাল ১০টায় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে বিকাল পর্যন্ত চলবে কাউন্সিল। এতে সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনটির সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।

সারাদেশ থেকে কওমি অঙ্গনের পাঁচ শতাধিক শীর্ষ আলেম হাটহাজারী মাদ্রাসায় উপস্থিত হয়ে মরহুম আমির আহমদ শফির উত্তরসূরী নির্বাচিত করবেন। হেফাজত ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফি চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেলে আমিরের পদটি শূন্য হয়।

শফিপন্থীরা অভিযোগ করেছেন, আজকের এ কাউন্সিলে সংগঠনটির নায়েবে আমীর আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদি, যুগ্ম-মহাসচিব মাইনুদ্দীন রুহী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, প্রচার সম্পাদক শফিপুত্র আনাস মাদানীসহ বর্তমান কমিটির বেশ কয়েকজন নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

এর মাধ্যমে আল্লামা শফির অনুসারীদের বাদ দিয়েই সংগঠনটির এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে হেফাজতের কাউন্সিল আয়োজনকারীরা বলছেন, যারা হেফাজতে সক্রিয় আছেন সকলকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তি আছেন, যারা উপস্থিত হলে বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে- তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে আহমদ শফির অনুসারীরা বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের নতুন কাউন্সিল ডাকার বৈধতা নেই।

ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, একটি চিহ্নিত মহল হেফাজতে ইসলামকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গভীর ষড়যন্ত্র করছে। একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হেফাজতের কাউন্সিলের নামে একতরফাভাবে কাউকে দায়িত্ব দিলে তা এ দেশের ওলামায়ে কেরাম মেনে নেবে না। ভিন্ন পথে কোনো কিছু করার ষড়যন্ত্র করা হলে তা দেশবাসী রুখে দেবে।

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফির অনুসারী একদল দাবি করেছেন, সংগঠনটির নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপি সমর্থকদের আনার তোড়জোড় চলছে। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আহমদ শফির ছোট শ্যালক মো. মঈন উদ্দিন। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির ছয় সদস্য এবং আহমদ শফির নাতি মাওলানা কায়সার।

সংবাদ সম্মেলনে আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানি উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ‘হত্যার হুমকি’ পেয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানানো হয়। অবশ্য তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কাউন্সিল না করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি আহমদ শফির মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ আখ্যায়িত করে তার বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

মঈন উদ্দিন বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে হুজুরের হাতে গড়া অরাজনৈতিক কওমী সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির, বিএনপির হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, এটা দিনের মতো পরিষ্কার, জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই কাউন্সিল।

সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলে যাবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাউন্সিলে যিনি সভাপতিত্ব করবেন (মহিবুল্লাহ বাবুনগরী) তিনি আগেই পদত্যাগ করেছেন। এরপর আর হেফাজতে ফিরে আসেননি। তাই এই কাউন্সিল অবৈধ। সাতজন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে পাঁচজন আমন্ত্রণ পাননি। ৩৫ জন নায়েবে আমিরের মধ্যে ২৩ জন এখনও দাওয়াত পাননি এবং তারা যেন আসতে না পারেন পরিকল্পিতভাবে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

হেফাজত নেতা আ ন ম আহমদ উল্লাহ বলেন, তবু আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। যদি দেখি তারা তাদের মত করে নেতৃত্ব নির্বাচন করে ফেলছে তখন আমরা শাহ আহমদ শফির ২০০০ খলিফাকে নিয়ে নতুন হেফাজতের কার্যক্রম ঘোষণা করবো।

অন্যদিকে হেফাজতের মুল অংশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী নন, সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মহাসচিব এই সম্মেলন ডেকেছেন। এতে সারা দেশ থেকে ৫০০ প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। সবার উপস্থিতিতে মুরুব্বিরা নেতা নির্বাচন করবেন।

কে হচ্ছেন নতুন আমির?

এদিকে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের আমির পদে বর্তমান সিনিয়র নায়েবে আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমির নূর হোসাইন কাসেমী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম আলোচনায় থাকলেও বর্তমান সময়ে কওমী অঙ্গনে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে জুনায়েদ বাবুনগরীই প্রয়াত আমীর আল্লামা শফির স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।

প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে হেফাজতে ইসলামের মূল নেতৃত্ব আমির-মহাসচিব চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হলেও এবার প্রধান এ দুই পদে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে সমন্বয় করে মূল নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ করার জোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা। সে হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে আমির নির্বাচিত করা হলে মহাসচিব করা হবে ঢাকার কাউকে। এক্ষেত্রে হেফাজতের বর্তমান নায়েবে আমীর নূর হোসাইন কাসেমীর নাম মহাসচিব পদে আলোচনার শীর্ষে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসা মিলনায়তনে দেশের শীর্ষ সব কওমী আলেমের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে গঠিত হয়েছিল কওমি আক্বীদা ভিত্তিক অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠন হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ। যদিওবা পরে অরাজনৈতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা এ সংগঠনটি দেশের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।

২০১০ সালের ওই সম্মেলনে আহমদ শফি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির মনোনীত হন। শুরুতে চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ মাদ্রাসার পরিচালক সুলতান যওক নদভীকে মহাসচিব করা হলেও পরে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় জুনায়েদ বাবুনগরীকে। নবী-রাসূলের অবমাননা, নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্যদিয়ে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ হলেও ২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে শাপলা চত্বর অবরোধের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক এ সংগঠনটি বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে।

Pin It