করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর সংক্রমিত দেশ থেকে যারা বাংলাদেশে ফিরেছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বিদেশফেরতদের মধ্যে কেউ করোনার লক্ষ্য লুকাচ্ছেন কিনা, সেদিকে নজর রাখছে পুলিশ-র্যাব। এমনকি করোনা প্রতিরোধে যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন তারা নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন কিনা, তার ওপর খেয়াল রাখতে জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করেছে পুলিশ। ওয়ার্ড থেকে শুরু করে থানা ও জেলা পর্যায়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, সুশীল সমাজের লোক ও পুলিশের একজন এসআইকে রাখা হয়েছে। এর আগে হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়মাবলি বিষয়ে খেয়াল রাখাসহ করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। সে আলোকেই হোম কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা যাতে সঠিকভাবে বিদেশফেরতরা মেনে চলেন, তা দেখভাল করতে কমিটি গঠন করা হলো। যদি কেউ হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়মাবলি অমান্য করেন তাহলে সংক্রামক রোগ আইন প্রয়োগ করা হবে। কোয়ারেন্টাইন নির্দেশনা না মানায় গতকাল মানিকগঞ্জে এক সৌদি প্রবাসীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সংশ্নিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল এসব তথ্য জানান। দেশের অনেক এলাকায় বিদেশফেরতরা হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম মানছেন না। তারা ঘরে থাকার বদলে বাইরে যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছেন। এতে করোনার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
পুলিশের সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার কথা জানিয়ে পুলিশের সকল ইউনিটকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়। কেউ যদি হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশনা না মেনে চলে, তার বিরুদ্ধে আইনও প্রয়োগ করা যায়। তবে আইন প্রয়োগের আগে সবাই নিজেই সতর্ক হয়ে যাবেন।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা তারা সরকারের সহানুভূতিশীল পরামর্শ অমান্য করলে সংক্রামক রোগ আইন প্রয়োগ করা হবে। আমরা চাই না এ ধরনের কোনো আইন প্রয়োগ হোক। আমরা চাই, সবাই মিলে একসঙ্গে করোনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখব।’
বিদেশফেরতদের সেলফ কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, ‘আমরা অনুরোধ করব, যাদের শরীরে করোনার লক্ষণ আছে, আক্রান্ত দেশ থেকে এসেছেন, তারা যেন আইইডিসিআরে সরাসরি চলে না আসেন। তারা হটলাইনে কল করুন। কারণ, আপনার শরীরে করোনাভাইরাস থাকলে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। আমরা বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করব। ই-মেইল ও ফোনে রিপোর্ট জানিয়ে দেবো।’
শেরপুরের পুলিশ সুপার আশরাফুল আজীম বলেন, ‘করোনা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ ছাড়াও মাস্কসহ হ্যান্ড স্যানিটাইজার সামগ্রী নিয়ে যাতে কেউ বাড়তি ব্যবসা না করতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুজ্জামান দোলা বলেন, ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে যাতে কেউ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক রয়েছেন। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে একজন নাগরিক হিসেবে সবার দায়িত্ব রয়েছে রোগটি যাতে অন্যত্র না ছড়ায়।’
আইইডিসিআর তথ্য অনুযায়ী দেশের আট বিভাগে দুই হাজার ৩১৪ জন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন চারজন। আর আইসোলেশনে আছেন ১০ জন।
শরীয়তপুর জেলার একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত ১ মার্চ থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ইউরোপ থেকে শরীয়তপুরের ২০২ জন বাসিন্দা দেশে ফিরেছেন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। আর ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত শরীয়তপুরের বাসিন্দা এমন পাঁচ হাজার ২০২ জন দেশে ফেরেন।
একাধিক জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করেনা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথমে লিফলেট বিলি করছেন তারা। এ ছাড়া কেউ যাতে অহেতুক আতঙ্কিত না হন সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন কর্মশালা, সচেতনতামূলক সভা-সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা পুলিশের ফেসবুক পেজে দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের পরামর্শ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী করোনার সংক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখার উপায় সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে জনপ্রতিধিদের নিয়ে নানা কর্মসূচির আয়োজন চলছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ, নির্মূল) আইন-২০১৮ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে অবহিত করা হচ্ছে। সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে এ আইনে উড়োজাহাজ, জাহাজ, জলযান, বাস, ট্রেন বা অন্যান্য যানবাহনে দেশে আগমন-নির্গমন বা দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল নিষিদ্ধ। সংক্রমিত ব্যক্তিকে এ আইনে সাময়িকভাবে জনবিচ্ছিন্ন করা যাবে। এ আইনে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
পুলিশের ১৬ দফা নির্দেশনা : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ১৬টি নির্দেশনা দিয়ে বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়- থানার ফোকাল পয়েন্ট অফিসারদের মাঝে ব্রিফিং দিতে হবে। জেলার অভ্যন্তরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ফোকাল পয়েন্ট অফিসারদের নিয়ে একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলে জরুরি নির্দেশনা ও তথ্যাদি আদান-প্রদান করতে হবে। এ-সংক্রান্ত লিফলেট ও ফেস্টুন সর্বত্র বিতরণ করার জন্য বলা হয়। ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে জেলায় কেউ আগমন করলে তার তথ্য সংগ্রহ করা। পরে ওই ব্যক্তিকে জেলায় বা থানায় গঠিত স্বাস্থ্য বিভাগের কমিটির মাধ্যমে কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেওয়া। আগত প্রবাসীদের একঘরে করে রাখতে, আক্রমণ বা জীবন সম্পদের ক্ষতি করতে না পারে তারা, সেই ব্যবস্থা নেওয়া। করোনা নিয়ে যাতে কেউ গুজব প্রচার করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদি মজুদ বা মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে, সেদিকে নজরদারি ও প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জেলা পুলিশের নিজস্ব সম্পদ, সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী আলাদা কর্মপরিকল্পনা তৈরি, যাতে সহজে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়। করোনাকে দুর্যোগ হিসেবে ধরে নিয়ে গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করে সবাইকে সতর্ক ও প্রস্তুত রাখা। দুর্যোগটি যথাযথ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্কাউট, রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট, গার্ল গাইডস, ভিডিপি ও গ্রাম পুলিশসহ সবাইকে ব্রিফিং দিয়ে প্রস্তুত রাখা। শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য হ্যান্ড লেজার স্ক্যানার, এন-৯৫ মাস্ক, চোখ রক্ষার জন্য বিশেষ চশমা, আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ পোশাক (কয়েক সেট) জেলা পুলিশ লাইনে সংগ্রহে রাখা। সবাইকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাসহ ব্যারাক, থানা-ফাঁড়ি, ক্যাম্পের মেসে সবুজ শাকসবজি ও ভিটামিন সি আছে এমন ফল খাওয়ার ব্যবস্থা করা; যা শরীরে ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে কাজ করতে পারে। পুলিশ কর্তৃক যে কোনো আসামি ধরার পর যদি জানা যায় সে করোনায় আক্রান্ত, তাহলে তা দ্রুত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা। ওই আসামিকে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা। করোনা সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর নির্দেশও দেওয়া হয়।
হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম : করোনাভাইরাসে যে ব্যক্তি আক্রান্ত বা কারও সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের আলাদা করে রেখে রোগের বিস্তার ঠেকানোর নাম কোয়ারেন্টাইন। ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পর থেকে রোগের পূর্ণ প্রকাশ হতে ১৪ দিন লাগে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটি আক্রমণ করেছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন জরুরি। হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম অনুযায়ী নিজ রুমে একা থাকতে হবে। সম্ভব হলে আলাদা টয়লেট ব্যবহার করা। সেটা না হলে ঘরে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে সবার পরে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তি টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। তিনি টয়লেট ব্যবহার করে ভালোভাবে তা পরিস্কার করে রাখবেন। যাতে অন্যরা পরে ওই টয়লেট ব্যবহার করলেও সেখানে জীবাণু না থাকে। নিজের তোয়ালে, গামছা, ব্যবহার করুন। নিজের বিছানা আলাদা রাখুন। সম্ভব হলে যে কোনো ধরনের সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলুন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও। সব সময় মাস্ক ব্যবহার ও অন্যের সঙ্গে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা। ঘন ঘন হাত ধুয়ে ফেলুন। যে কক্ষে থাকবেন তার দরজার বাইরে খাবার রেখে যাবে অন্য কেউ। পরে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তি তা সংগ্রহ করে খাবেন। খাবারের পর তা সঠিকভাবে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ বা প্লেট থেকে জীবাণু না ছড়ায়। দরজার হাতল, কম্পিউটার, ফোনসহ যেসব জিনিসপত্র বারবার স্পর্শ করা দরকার, তা বারবার জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।