স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন কক্সবাজারের ১০২ জন ইয়াবা চোরাকারবারি।
শনিবার সকালে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারী এই ১০২ জনের মধ্যে ২৪ জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় ‘গডফাদার’ হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। ওই তালিকায় টেকনাফের সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির নাম থাকলেও তিনি আত্মসমর্পণ করেননি।
তবে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে বদির চার ভাইসহ আট স্বজন রয়েছেন।
অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারীরা সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০টি দেশে তৈরি বন্দুক এবং ৭০টি গুলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। পরে তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ইয়াবা কারবারি অন্যদেরও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় না দেওয়ার অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
“বাংলাদেশ এখন মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। মাদক নির্মূলে সরকার কঠোরতা অবলম্বন করবে; এতে কেউ ছাড় পাবে না।
প্রবেশদ্বার খ্যাত টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে পাচার হয়ে আসা ইয়াবা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশের এমন কোনো অঞ্চল বা এলাকা নেই যেখানে ইয়াবার ‘করাল থাবা’ পড়েনি। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে জীবনঘাতী ইয়াবা সেবনে। এতে নতুন প্রজন্মের মেধা ও মনন প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে।
মাদক ব্যবসায়ীদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে মাদক নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।
পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যেসব মাদক কারবারি অংশগ্রহণ করেনি তাদের হুঁশিয়ার করে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, এখনও সময় আছে অপরাধ স্বীকার করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার। এরপরও যারা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
“যেসব ইয়াবা ব্যবসায়ী সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে তাদের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানো হবে। তবে আত্মসমর্পণের পর যদি কেউ আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে তার প্রতি দ্বিগুণ ভয়াবহ আচরণ করা হবে।”
আত্মসমর্পণকারীদের জন্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তার আওতায় তাদের বিষয়ে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্ত্রী জানান।
তিনি বলেন, এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে আত্মসমর্পণকারী কোনো ব্যক্তি ভবিষ্যতে পুনরায় মাদক ব্যবসায় জড়াবেন না, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়ে স্ব স্ব এলাকা মাদকমুক্ত রাখতে ভূমিকা পালন করবেন। যারা এখনও মাদকপাচারে জড়িত রয়েছে তাদের বিষয়ে পুলিশের কাছে তথ্য দেবে, আত্মসমর্পণের আগে তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো তারা নিজেরাই আইনগতভাবে মোকাবেলা করবে।
“এছাড়াও আত্মসমর্পণকারী মাদক ব্যবসায়ীদের হেফাজতে থাকা মাদকদ্রব্য ও অবৈধ অস্ত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে।”
আত্মসমর্পণের আওতায় মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের হবে তাতে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে তাদের আইনগত সুবিধা দেওয়া হবে বলেও মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
স্বজনসহ নিজেদের নামে বেনামে অর্জিত স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি দুদক, সিআইডি (মানি লন্ডারিং শাখা) ও এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে যাচাই সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার শর্তে এসব মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. জাবেদ পাটোয়ারী অন্য চোরাকারবারিদেরও আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “মাদক ব্যবসায়ী যে-ই হোক তার সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হবে। মাদক নির্মূলে সর্বাত্বক ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনী মাঠে রয়েছে। আপনাদের মধ্যে যারা ঘাপটি মেরে আছেন, তাদের কাছে কঠোর বার্তা দিতে চাই- হয় আত্মসমর্পণ করেন, নইলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ মাদক পাচারে যুক্ত থাকলে তাদের বিষয়েও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন পুলিশ প্রধান।
আত্মসমর্পণকারীদের অভয় দিয়ে তিনি বলেন, “যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যা যা করণীয়, তা করা হবে, আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে তাদের। আইনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে যেন তা নিষ্পন্ন করা যায়, সেই ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।”
সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাপাচার রোধে বিজিবির আরও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা উচিত মন্তব্য করে আইজিপি বলেন, “মাদক ব্যবসার সঙ্গে যদি পুলিশ বা আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো সদস্য জড়িত থাকে তার সঙ্গে ‘মাদক ব্যবসায়ীদের’ মতো আচরণ করা হবে।”
“মাদক নির্মূলের মধ্য দিয়েই সরকারের রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজকে এগিয়ে নেওয়া হবে,” বলেন জাবেদ পাটোয়ারী।
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এ রকম আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার কথাও জানান আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী।
ইয়াবা নির্মূলে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা মাদককে নির্মূল করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের স্থানীয় চার সংসদ সদস্য জাফর আলম, আশেক উল্লাহ রফিক, সাইমুম সরওয়ার কমল ও শাহীন আক্তার চৌধুরী, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কক্সবাজার কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজনে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার অবস্থান করে সার্বিক প্রস্তুতির তত্ত্বাবধান করছিলেন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্মতি জানানোর পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগে জেলা পুলিশও তৎপরতা শুরু করে। এতে অনেকে সাড়া দিয়ে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে নিরাপদ হেফাজতে আসেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে মাদকের মধ্যে ইয়াবা ট্যাবলেটের কথাই সবার আগে আসে। এই ইয়াবা আসে মূলত মিয়ানমার থেকে। ইয়াবা পাচার বন্ধে মিয়ানমার সরকারের সহায়তা চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না বলে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর মধ্যেই গত বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের প্রশ্নবিদ্ধ অভিযানে কয়েকশ জন নিহত হলেও ইয়াবা কারবার বন্ধ করা যায়নি।
এই অবস্থায় নতুন বছরের শুরুতে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়।
এর মধ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক গত ১৫ জানুয়ারি ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানালে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দেয়।
কক্সবাজারের চিহ্নিত মাদক পাচারকারীদের একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের আগ্রহ জানালে বিষয়টি আকার পেতে শুরু করে।
আত্মসমর্পণকারীদের তালিকা
বদির ভাই আব্দুর শুক্কুর (৩৩), বদির ভাই আমিনুর রহমান ওরফে আব্দুল আমিন (৪১), নুরুল হুদা (৩৮), দিদার মিয়া (৩৫), বদির ভাগনে মো. সাহেদ রহমান নিপু (৩৩), আব্দুল আমিন (৩৪), নুরুল আমিন (৩৭), বদির ভাই শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক (২৯), বদির ভাই ফয়সাল রহমান (২৯), এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার (২৪), একরাম হোসেন (২৫), ছৈয়দ হোসেন (৫৫), বদির বেয়াই সাহেদ কামাল ওরফে সাহেদ (৩২), মৌলভী বশির আহমদ (৬৫), শাহ আলম (৩৫), আব্দুর রহমান (৩০), মোজাম্মেল হক (২৮), জোবাইর হোসেন (৩০), নুরুল বশর ওরফে কাউন্সিলার নুরশাদ (৩১), বদির ফুপাত ভাই কামরুল হাসান রাসেল (৩৫), আব্দুর রহমান (৩২), জিয়াউর রহমান ওরফে জিহাদ (২৭), মোহাম্মদ শাহ (৫৮), নুরুল কবির (৩৫), মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু (৩০), মোহাম্মদ ইউনুচ (৪৮), ছৈয়দ হোসেন ওরফে ছৈয়দু (৫৬), মোহাম্মদ জামাল ওরফে জামাল মেম্বার (৫২), মো. হাসান আব্দুল্লাহ (৩৪), রেজাউল করিম ওরফে রেজাউল মেম্বার (৩৪), মো. আবু তাহের (৪১), রমজান আলী (২৮), ফরিদ আলম (৪২), মাহবুব আলম (৩৬), মোহাম্মদ আফছার (২৪), হাবিবুর রহমান ওরফে নুর হাবিব (২৪), শামসুল আলম ওরফে শামশু মেম্বার (৩২), মোহাম্মদ ইসমাঈল (৩৪), আব্দুল গনি (৩৩), মোহাম্মদ আলী (৩৭), জামাল হোসেন (৫৩), আব্দুল হামিদ (৩৫), নজরুল ইসলাম (৫২), রশিদ আহমেদ ওরফে রশিদ খুলু (৫৪), মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে দানু (৩৭), মোহাম্মদ সিরাজ (২৮), মোহাম্মদ আলম (৪৫), মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (৩৬), হোসেন আলী (২৭), মোহাম্মদ তৈয়ব (৪৬), নুরুল কবির মিঝি (৫৫), শাহ আজম (২৮), জাফর আহমেদ ওরফে জাফর (৪৩), জাফর আলম (৩৭), রুস্তম আলী ওরফে রুস্তম (৩৫), মোহাম্মদ হোছাইন (৩২), নুরুল আলম (৩৬), মোহাম্মদ হাশেম ওরফে আংকু (৩৮), শফি উল্লাহ (৩৮), আবু তৈয়ব (৩১), আলী নেওয়াজ (৩১), মো. জহুর আলম (৩০), মোহাম্মদ হুসাইন (৩৫), মোহাম্মদ সিদ্দিক (৩৪), রবিউল আলম (৩৬), মঞ্জুর আলী (৩৫), হামিদ হোসেন (৩৪), মোহাম্মদ আলম (৩৫), মোহাম্মদ আইয়ুব (৩৫), মোহাম্মদ রাসেল (২৮), নুরুল আমিন (৩৫)৷ বোরহান উদ্দিন (৩৪), কামাল হোসেন (২৬), ইমান হোসেন (৩০), মোহাম্মদ হারুন (২০), শওকত আলম (৩০), হোছাইন আহম্মদ (২৫), মোহাম্মদ আইয়ুব (২৮), মো. আবু ছৈয়দ (২৫), মো. রহিম উল্লাহ (২৯), মোহাম্মদ রফিক (৩২), মোহাম্মদ সেলিম (৩২), নুর মোহাম্মদ (৪২), নুরুল বশর ওরফে কালাভাই (৪০), খালাত ভাই মং অং থেইন ওরফে মমচি (৪৮), মোহাম্মদ হেলাল (৩২), বদিউর রহমান ওরফে বদুরান (৪৭), আব্দুল করিম ওরফে করিম মাঝি (৪০), ছৈয়দ আলম (৪০), মোহাম্মদ হাছন (৩২), নুরুল আলম (২৬), আব্দুল কুদ্দুস (২৪), দিল মোহাম্মদ (৩৪), আলী আহম্মেদ (৩৫), মো. সাকের মিয়া ওরফে সাকের মাঝি (২৮), আলমগীর ফয়সাল ওরফে লিটন (৩০), জাহাঙ্গীর আলম (২৮), নুরুল আলম (৩৮), সামছুল আলম শামীম (৩৫), মোহাম্মদ ইউনুচ (২২), নুরুল আফসার ওরফে আফসার উদ্দিন (৪২), মোহাম্মদ শাহজাহান আনছারী (৩৮)।