অব্যাহত বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে দেশের সব প্রধান নদনদীর পানি বাড়ছে। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা, কুশিয়ারা, যমুনা, তিস্তা ও ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, সোমেশ্বরী, কংস, সাংগু, হালদা, মাতামুহুরী ও ফেনী নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই। অব্যাহত বৃষ্টির কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ১০ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। আশঙ্কা করা হচ্ছে বড় বন্যার। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সবজি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পানির তোড়ে এক শিশু ভেসে যাওয়ার পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় ১৭ হাজার ৫৫০ টন খাবার ও নগদ দুই কোটি ৯৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক জেলায় দুই হাজার প্যাকেট উন্নতমানের শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বন্যাকবলিত এলাকায় মেডিকেল টিম কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকরা মাঠপর্যায়ে ইউএনওসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি তদারকি করছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ৬২৮টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি পয়েন্ট অতি ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ৫২১টি পয়েন্টকে ঝুঁকিমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বন্যা-উপদ্রুত জেলাগুলোতে প্রথমে ২০০ টন এবং পরে ৩০০ টন খাবার পাঠানো হয়েছে।
সমন্বয় সভায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল, জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, কংস, সোমেশ্বরী, কংস সাঙ্গু ও তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট ও বরিশাল বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী, সাঙ্গুসহ প্রধান প্রধান নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ধরলা, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদনদীর পানি বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
রংপুর : তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে গতকাল সকালে পানি বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে করে তিন উপজেলার ১১ ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সংকট দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির। গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, চর শংকরদহ, পূর্ব সরকারটারী, গজঘণ্টা ইউনিয়নের গাওছওয়া, পূর্ব গজঘণ্টা চরের গ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তু্তুতির কথা জানিয়ে ইউএনও তসলীমা বেগম বলেন, সরকারি সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। দুর্গত মানুষের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে।
বগুড়া:যমুনা নদীসংলগ্ন সোনাতলা উপজেলার তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের খাবুলিয়া, জৈন্তিয়ারপাড়া, মহব্বতেরপাড়া ও ভিকনেরপাড়া চরের ৮৫টি ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ১৪০টি ঘরবাড়ি। উপজেলার পাকুল্লা ইউনিয়নের মির্জাপুর, রাধাকান্তপুর, বালুয়াপাড়া, সর্বসুজাইতপুর ও খাটিয়ামারী এলাকার প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সিলেট:নতুন করে গতকাল প্লাবিত হওয়ায় কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, ধলাই, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি ও জাফলং পাথর কোয়ারির সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ধলাই ও পিয়াইন নদীতে পানি বাড়ায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সবকটি হাওর তলিয়ে গেছে। উপজেলার ছয় ইউনিয়নের গ্রামের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় উপজেলার ৬০টি বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গোয়াইনঘাটে বন্ধ রয়েছে ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গতকাল সন্ধ্যায় কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম বলেন, বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। ইতিমধ্যে গোয়াইনঘাটে ১৮ টন, জৈন্তাপুরে ১০ এবং কোম্পানীগঞ্জে ৮ টন ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ : সুরমা নদীর পানি গতকাল সন্ধ্যায় বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। গতকাল দুপুরে শহরের সুনামগঞ্জ-হালুয়ারঘাট সড়ক ভেঙে সদর উপজেলার কোরবাননগর, সুরমা, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের একাংশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তাহিরপুরে বন্যায় গৃহহারা মানুষ আশপাশের বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। ছাতকের কালারুকা, চরমহলা, জাউয়াবাজার, দোলারবাজার, ভাতগাঁও, উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, সিংচাপইড়, গোবিন্দগঞ্জ- সৈদেরগাঁও, ছৈলা-আফজলাবাদ, ছাতক সদর ইউনিয়নসহ পৌরসভার বেশকিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ও নোয়ারাই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বেশ কয়েকটি খামারের মাছ ভেসে গেছে। পানি ওঠায় এই উপজেলায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
মৌলভীবাজার :কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার অংশে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সদর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম নামক স্থানে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচু অংশ দিয়ে পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে ওই গ্রামের অন্তত ৫০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম):ন্যার পানির স্রোতে ভেসে যাওয়া আট বছরের শিশু সাইমুনুল ইসলাম সানির মরদেহ গতকাল বিকেলে উদ্ধার করা হয়েছে। সে উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের কালা গাজী সিকদার বাড়ির মোহাম্মদ রফিকের ছেলে। সকালে শিশুটি স্রোতে ভেসে গেলে এলাকাবাসী ও ডুবুরিদল তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বাড়ির পাশের একটি ডোবা থেকে জালের সাহায্যে তার মরদেহ উদ্ধার করে এলাকাবাসী।
চকরিয়া (কক্সবাজার) :গতকাল ভোররাতে মাতামুহুরী নদীর চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের পরুত্যাখালী পয়েন্টে পাউবোর একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে চকরিয়ার উপকূলীয় সাত ইউনিয়নের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
খাগড়াছড়ি:বৈরী আবহাওয়ায় পাহাড়ধস ও বন্যার আশঙ্কায় রাঙামাটির সাজেকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে গতকাল থেকে দু’দিন সতর্কতা জারি করে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
গাইবান্ধা :নদী-তীরবর্তী এলাকার চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। সুন্দরগঞ্জে তিস্তার পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারও পরিবার। নদীভাঙনের তীব্রতাও বেড়েছে। গতকাল ইউএনও সোলেমান আলী কাপাসিয়া ইউনিয়নের উত্তর লালচামার, লালচামার, উজান বুড়াইল, ভাটি বুড়াইল এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।
ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তলিয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের নিম্নাঞ্চল। ব্রহ্মপুত্রের ডানতীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর উড়িয়া, গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারী ও ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারী, উজাল ডাঙা এলাকায় নতুন করে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে এসব স্থানে নদীভাঙনের শিকার ৫০টি পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে যে কোনো সময় বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায়তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
কুড়িগ্রাম : ধরলা নদীর পানি গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিপদসীমা অতিক্রম করে দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে সদর ও উলিপুর উপজেলার যাত্রাপুর, ঘোগাদহ, পাঁচগাছি, ভোগডাঙ্গা, মোগলবাসা ও উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন।
নেত্রকোনা : জেলার দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দায় গতকাল নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে কলমাকান্দা উপজেলার আটটি ইউনিয়নের প্রায় সবক’টি। বন্যায় তিন উপজেলায় অন্তত দুই শতাধিক গ্রামে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি। গ্রামীণ বেশকয়েকটি সড়ক পানির নিচে থাকায় উপজেলা ও জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুম :সারাদেশের বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৪২৫ নম্বর রুমে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর ০২৯৫৭০০২৮। আগামী আরও দু’দিন দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ভারি বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।