বগুড়ার আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানা বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে সোমবার তিনি দলটির সকল পদ এমনকি সাধারণ সদস্য থেকেও পদত্যাগের কথা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে পাঠানো সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ গ্রহণের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শোকরানা পদত্যাগের এ সিদ্ধান্ত নিলেন।
যোগাযোগ করা হলে শোকরানা বিএনপি থেকে পদত্যাগের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এখন রাজনীতি যেভাবে চলছে, সেটা আমার পক্ষে আর নেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এখন বয়সও হয়েছে। অক্টোবর মাসে আমার বয়স ৭০ হবে, তাই আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তার এ পদত্যাগের সঙ্গে দুদকের নোটিশের কোন যোগসূত্র নেই বলেও দাবি করেন শোকরানা। অবশ্য বগুড়া জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দ তার এ পদত্যাগের সিদ্ধান্তটিকে ব্যক্তিগত বলেই মনে করেন।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাংসদ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, ‘তিনি আর রাজনীতি করবেন না বলে কিছুদিন আগে আমাকেও বলেছিলেন। সেই সিদ্ধান্তটা তিনি আজ আনুষ্ঠানিকভাবেই নিলেন।’
বগুড়ার তিন তারকা খচিত হোটেল নাজ গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী সাবেক যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ শোকরানা প্রায় কুড়ি বছর আগে ১৯৯৯ সালে তারেকের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। এরপর ক্রমেই তিনি তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বিএনপি থেকে পদত্যাগের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বগুড়া জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এর আগে তিনি জেলা বিএনপির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য এবং উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। মাঝে ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে শোকরানা বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বগুড়া-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে পরাজিত হন। তবে ২০১৮ সালে ওই একই আসনে তিনি আবারও মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধয়াক সরকারের শাসনামলে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ডাল মজুদ এবং সরকারি ত্রাণের কম্বল রাখার অভিযোগে তৎকালীন যৌথবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। ওই ঘটনায় মোহাম্মদ শোকরানা এবং পরিমল কুমার সিং নামে তার এক সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। অবশ্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলাটির বিচার কাজ চলা অবস্থায় ২০১১ সালের নভেম্বরে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুবলীগের দাপুটে নেতা শোকরানার বিরুদ্ধে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়ে বগুড়া শহরে একাধিক হত্যাসহ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গ্রেফতার হওয়া শোকরানা মাত্র ৬ বছর কারাবাসের পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে মুক্তি পান। এরপর কিছুদিন তিনি পুরোপুরি ব্যবসায় মনোযোগী হন। তবে এরশাদের শাসনামলে তিনি জাতীয় পার্টিতে ভিড়েন এবং ওই দলটির বগুড়া শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। এরশাদ পতনের পর প্রায় ৯ বছর তিনি রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় ছিলেন।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পর থেকেই শোকরানা মনক্ষুন্ন হন। তখন থেকেই তিনি দলীয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে থাকেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি তিনি হোটেল নাজ গার্ডেন বিক্রির কথাও বলেছিলেন। তবে বগুড়া জেলা বিএনপিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হবে-এমন আশ্বাসে তাকে দলীয় রাজনীতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করে বিএনপি। কিন্তু চলতি বছর ১৫ মে বগুড়া জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে যায়।
শোকরানার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, সর্বশেষ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে সম্পদের হিসাব চেয়ে তার নামে নোটিশ পাঠানোর পর থেকে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে থাকাটা আর নিরাপদ মনে করছেন না। দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম স্বাক্ষরে গত ২১ সেপ্টেম্বর পাঠানো ওই নোটিশে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান করে কমিশনের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে- তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাই নোটিশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তার নিজের, নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, দায়-দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ নির্ধারিত ফরমে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
দুদকের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো ওই নোটিশটি সোমবার সকালে মোহাম্মদ শোকরানা গ্রহণ করেন।
বিএনপি থেকে পদত্যাগের সঙ্গে দুদকের সম্পদ বিবরণী নোটিশের কোন যোগসূত্র আছে কি/না- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ শোকরানা বলেন, ‘না। এটা ঠিক না। যদিও ওই নোটিশটি আমি আজই (সোমাবার) গ্রহণ করেছি। কিন্তু এটা তো দ্বিতীয় নোটিশ। তাদের প্রথম নোটিশ তো তিনমাস আগেই আমি রিসিভ করেছি। পদত্যাগ করলে তখনই করতে পারতাম।’
অন্য কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আর রাজনীতিই করবো না। এটিই আমার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
মোহাম্মদ শোকরানার পদত্যাগের বিষয়ে দলের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি বগুড়া জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাংসদ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, ‘তিনি (শোকরানা) কুড়ি বছর আগে বিএনপিতে এলেও ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী এক যুগ দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এজন্য আমরা তাকে চিরদিন স্মরণ করবো। যেহেতু পদত্যাগের সিদ্ধান্তটি তিনি ব্যক্তিগতভাবেই নিয়েছেন তাই এটিকে দলীয়ভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।’