প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট তাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তখনকার ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি জড়িত ছিল’ বলেই সেদিন সংসদে ওই ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগকে কথা বলতেও ‘বাধা’ দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বর্বর সেই হামলায় নিহতদের স্মরণে শুক্রবার আওয়ামী লীগের আয়োজনে এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে সময় ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা। আর সেই সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত।
সেই হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের তখনকার মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ। সেদিন বেঁচে গেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় যুক্ত হয়ে বর্বর সেই হামলার কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলার পর তখনকার ক্ষমতাসীনরা কীভাবে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছিল, সে কথাও বলেন।
“একটা দেশে এই রকম একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আমি বিরোধী দলের নেতা, আমার উপর এমন একটা গ্রেনেড হামলা… বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মত একটি দল, যে দল দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সেই দলের একটা সভায় এমন একটা গ্রেনেড হামলা, আর পার্লামেন্টে যিনি সংসদ নেতা, লিডার অফ দ্য হাউস, প্রধানমন্ত্রী, সে দাঁড়িয়ে বলে দিল- ‘উনাকে আবার কে মারবে’।
“এখন তো বলতে হয় যে আপনিই তো মারবেন। চেষ্টা করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, সেই জন্য আর পারছেন না। সেইদিন এই রকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলে আমাদেরকে কোনো কথা বলতে দেয় নাই এই হামলা সম্পর্কে। অথচ আমাদের নেতাকর্মীরা, পার্লামেন্ট মেম্বাররা (তখন) আহত অবস্থায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।”
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, “আমাদের সেই অধিকারটুকু পার্লামেন্টে ছিল না যে এর উপর আমরা আলাপ আলোচনা করতে পারি। আমাদের কাউকে মাইক দেয়নি, আলোচনা করতে দেয়নি। এর থেকে কী প্রমাণ হয়? তারা যদি সরাসরি জড়িত না থাকবে, তাহলে কি এই রকমভাবে বাধা দিত?”
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বিকালে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি শোভাযাত্রায় যোগ দিতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। রাস্তায় ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই যে সেদিনের ওই হামলা হয়েছিল, পরে তা তদন্তেও বেরিয়ে আসে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
বিএনপি-জামাত জোট সরকার পুরো দেশটাকেই ‘সন্ত্রাসের রাজত্বে’ পরিণত করেছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না, আল্লাহ বোধহয় এ কারণেই বাঁচিয়ে রেখেছেন… বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু যাতে করতে পারি, সেই জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন। নইলে এই রকম অবস্থা থেকে বেঁচে আসা, এটা অত্যন্ত কষ্টকর।”
শেখ হাসিনা বলেন, “প্রকাশ্য দিবালোকে এই ধরনের গ্রেনেড হামলা বোধ হয় পৃথিবীতে আর কখনো কোথাও ঘটেনি। সাধারণত রণক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের সেই র্যালিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং আমাকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই ওই ঘটনাটা ঘটিয়েছিল।”
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা, এরপর ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কথাও এ অনুষ্ঠানে মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা জড়িত ছিল, তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করার ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ওই চক্রান্তের সাথে খন্দকার মোশতাক যেমন জড়িত, সেই সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত। জিয়াউর রহমান জড়িত এই কারণে, খন্দকার মোশতাক অবৈধভাবে ক্ষমতা যখন দখল করে, জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান করে। আবার জিয়াউর রহমানই সেনাবাহিনী প্রধান থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়। এবং যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, একটি পরিবারকে হত্যা করেছে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস করেছে, তাদেরকেই বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়, পুরস্কৃত করে।”
খুনিদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ‘ঘনিষ্ঠতা ছিল’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “সেটাতো খুনি কর্নেল রশীদ, কর্নেল ফারুক তাদের বিবিসির ইন্টারভিউতে খুব স্পষ্টভাবে তারা বলেছে এবং তারা পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান যে তাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ… এবং তাদের সঙ্গে যে সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছিল, এটাতো আজকে দিবালোকের মত স্পষ্ট।”
“আর তারই স্ত্রী খালেদা জিয়া, সে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই এই ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটায় এবং এর সঙ্গে তার ছেলে তারেক রহমান যে জড়িত, সেটাতো… ওই যারা ষড়যন্ত্রে জড়িত তাদেরই তো কথায় বের হয়ে এসেছে, যে তারা কোথায় মিটিং করেছে, কীভাবে ওই ষড়যন্ত্র করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার আগে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা ছিল যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কোনোদিন হতে পারবে না। এই ভবিষ্যতবাণী খালেদা জিয়া কীভাবে দিয়েছিল? কারণ তাদের চক্রান্তই ছিল যে আমাকে তারা হত্যা করে ফেলবে। তাহলে তো আর আমি কিছুই হতে পারব না। এটাই তাদের চক্রান্ত ছিল। তাদের বক্তব্যের মধ্যে… প্রতিটি ঘটনার আগে তার বক্তৃতাগুলো যদি আপনারা অনুসরণ করেন, দেখবেন ঠিক এই কথাগুলোই বলেছে।”
তিনি বলেন, “এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। আপনারা জানেন যে আমেরিকায় আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে কিডন্যাপ করে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সেটা ধরা পড়ল কার কাছে? আমেরিকার যে সংস্থা এফবিআই, তাদেরই তদন্তে এটা বের হয় এবং তারাই যখন এটা তদন্ত করে তখন সেখানে বিএনপির নেতা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়।
“সেখানে যে রায় দেয়, সেখানে বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান এবং শফিক রেহমান- তাদের নামও বেরিয়ে আসে। (যুক্তরাষ্ট্রে) যে শাস্তি পায়, সে যে তারেক জিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে এই ঘটনা ঘটিয়েছিল যে জয়কে কিডন্যাপ করে হত্যা করবে, এটা কিন্তু আমরা কখনো জানতে পারতাম না যদি এফবিআই এটা খুঁজে বের না করত বা মামলার রায় না বের হত।”
২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার সময় ঢাকার সাবেক মেয়র মো. হানিফসহ দলীয় নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মামলা তদন্তের সব ধরনের আলামত নষ্ট করে দিয়ে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায়।
বিএনপি সরকার যদি এর সঙ্গে জড়িত নাই থাকবে, তাহলে তারা কেন আলামত নষ্ট করল- সেই প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির বিবেকের কাছে আমার প্রশ্ন, এটা কি তারা কখনো চিন্তা করেছে? কেন সেই সময় আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না নিয়ে সেখানে টিয়ারগ্যাস মারা হল আর লাঠিচার্জ করা হল? যারা নিজের আপনজনকে তুলতে গিয়েছে, পুলিশ তাদের লাঠি দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে- যে কেন তারা সাহায্য করবে।.ওই হামলাকারীরা যাতে নির্বিঘ্নে ওই জায়গা ত্যাগ করতে পারে, সেই সুযোগটা সৃষ্টি করবার জন্যই তারা এটা করেছিল। সরকারের মদদ না থাকলে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা এভাবে হতে পারে না।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বিএনপির কাছে ক্ষমতা হচ্ছে দুর্নীতি করে টাকা বানানো। তারা যে দুর্নীতি করে গেছে এবং দুর্নীতির যে বিষবৃক্ষ রচনা করে গেছে সারা বাংলাদেশে, আজকে তার কুফল বাংলাদেশ ভোগ করছে। আমরা সরকারে আসার পরে এক এক করে সেগুলো ধরছি, উদঘাটন করছি।”
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান প্রসঙ্গ ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দুর্নীতির এত টাকা যে, বিদেশে গিয়ে, এই ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি, যে সাজাপ্রাপ্ত, সে যেভাবে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে, কই আমরাতো তা পারি না। কিন্তু তারা করছে। কোথা থেকে পাচ্ছে এত টাকা? সেটাই তো প্রশ্ন।”
আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপসহ দলের কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।