উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ২০২৪-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই।
গত এক দশক ধরে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে বলেই উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করুন। অতীতে আওয়ামী লীগকে দেওয়া ভোট বৃথা যায়নি। বুধবার কক্সবাজারের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি একথা বলেন।
বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি এ দেশকে মানি লন্ডারিং, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস এবং লুটপাট ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। তারা আন্দোলনের নামে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারে। ৫শ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তিন হাজার জনকে পুড়িয়ে দগ্ধ করেছে। ধ্বংস ছাড়া দলটি কিছুই দিতে পারে না।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় আরও ২টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। বক্তব্যের আগে তিনি স্টেডিয়াম মাঠেই পৃথক উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে ২টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ৪টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
নৌকার আদলে গড়া জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেত জনতাকে প্রশ্ন করেন-আপনারা কি নৌকায় ভোট দেবেন? এ সময় জনতা সম্মতি জানান। শেখ হাসিনা তাদের হাত তুলতে বললে হাত তুলে আবার সম্মতি জানান তারা। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এটুকুই বলব-রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি, দেবার কিছু নেই। আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’
এক দিনের সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকতে ২৮ দেশের নৌবাহিনীর অংশগ্রহণে নৌ মহড়ার উদ্বোধন করেন। পরে জনসভাস্থলে গিয়ে এক হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। একই সঙ্গে ৫৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৬ মে তিনি এই জেলা সফর করেন। এর ঠিক সাড়ে তিন মাস পর মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা দলে দলে কক্সবাজারে প্রবেশ করে।
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে আশ্রয় দেওয়ার জন্য জেলার মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চেষ্টা হচ্ছে এই সমস্যা সমাধানের। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের (রোহিঙ্গারা) নিজ দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই জেলার মানুষকে খুবই ভালোবাসতেন। আমিও কক্সবাজারের মানুষকে ভালোবাসি। সেজন্য জেলার উন্নয়নে ক্ষমতার পরপরই বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ সময় তিনি কবিতার সুরে বলেন, ‘যত দূরেই থাকেন আপনারা আমার হৃদয়ে আছেন, হৃদয়ের অন্তস্থলে আছেন।’
জনসভাকে কেন্দ্র করে সকালে মিছিলের শহরে পরিণত হয় কক্সবাজার। ধারণা করা হয়, কয়েক লাখ মানুষ জনসভায় যোগ দিতে আসেন। যদিও জনসভাস্থল স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন মাত্র অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এ কারণে গ্যালারির পার্শ্ববর্তী অংশ ছিল ফাঁকা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানান, স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজিরবিহীন কড়াকড়ির কারণে বেশিরভাগ মানুষ প্রবেশ করতে পারেননি। অনেকে বিরক্ত হয়ে প্রবেশ করেননি। আবার অনেকে মিছিল নিয়ে শহরে পৌঁছার পর ফিরে গেছেন। সব মিলিয়ে জনসভাস্থলের চেয়ে কয়েকগুণ মানুষের উপস্থিতি ছিল বাইরে রাস্তাঘাটে।
দুপুর ১২টার দিকে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, গীতা ও ত্রিপিটক পাঠের মধ্য দিয়ে জনসভা শুরু হয়। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলাম আমিন, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ বক্তব্য দেন। এছাড়াও বক্তব্য দেন-মজিবুর রহমান, মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, আশিকুর রহমান, জাফর আলম এমপি, আশেক উল্লাহ রফিক এমপি, সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি, কানিজ ফাতেমা আহমেদ এমপি, প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া, মাহবুব মোর্শেদ, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, আলমগীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ শহীদ, সিরাজুল ইসলাম বাবলা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, তারেক বিন ওসমান, শামশুল আলম মণ্ডল প্রমুখ।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে তুলব। ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছিলেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যে গ্রেনেড যুদ্ধের মাঠে ব্যবহার করা হয় সেই গ্রেনেড মারা হয়েছিল আমাদের ওপর। গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ অনেকে মারা গেছেন। আল্লাহর রহমতে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছি। আসলে ধ্বংস করা ছাড়া বিএনপি-জামায়াত এ দেশকে কিছুই দিতে পারে না। ’৭৫-এর পর এরা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। কি দিয়েছে বাংলাদেশকে? তারা কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু আমরা দিয়েছি, আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে। নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে বক্তৃতার শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনানন্দ দাশের কবিতার অনুকরণে বলেন, ‘আবার আসিবো ফিরে এই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের তীরে।’ জনসভায় প্রায় ৩০ মিনিট বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ফুটবলের মাঠে খেলা হচ্ছে। রাজনীতির মাঠেও খেলা হবে। তৈরি আছেন তো? খেলা হবে ভোটচুরি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তিনি বক্তব্যের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধুর মায়াবী স্মৃতি ঘেরা ঝাউগাছ, সৈকতের কথা স্মরণ করেন। এরপর ওবায়দুল কাদের জানতে চান, ‘অনরা ক্যান আছন? ভালো আছন (আপনারা কেমন আছেন? ভালো আছেন)? তিনি বলেন, কক্সবাজারের যে রূপান্তর তার রূপকার শেখ হাসিনা। যিনি ধ্বংস স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনা করেন। তিনি বেঁচে আছেন বলেই আমরা শান্তিতে আছি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি নয়াপল্টনে কেন সমাবেশ করতে চাচ্ছে আমাদের কাছে পরিষ্কার। তারা আগুন নিয়ে রাস্তায় নামতে চায়। একটু আগে জানলাম পুলিশের ওপর নাকি আক্রমণ করেছে বিএনপি। আসলে ফখরুলের অন্তরে জ্বালা। বুকে বড় ব্যথা। কেন জানেন? পদ্মা সেতু শেখ হাসিনা করেই ফেললেন। ফখরুল সাহেব বাড়াবাড়ি, লাফলাফি করবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মরে গেছে। তারে জীবিত করার কি দরকার? ফখরুল সাহেব তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে চিন্তায়। কিন্তু কোনো লাভ হবে না।’
কক্সবাজারের সঙ্গে মহেশখালী উপজেলার সংযোগ সেতু ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলাবাসীর ১১ দফা দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু তার কোনোটিই স্থান পায়নি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায়। এতে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন।
উদ্বোধন হওয়া ২৯ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে-কক্সবাজার গণপূর্ত উদ্যান, বাহারছড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মাঠ, কুতুবদিয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ভবন, উপজেলা ভূমি অফিস ভবন, পেকুয়া; কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় ভবন, শেখ হাসিনা জোয়ারিয়ানালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একাডেমিক ভবন, আবদুল মাবুদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একাডেমিক ভবন, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একাডেমিক ভবন; কক্সবাজার জেলার লিঙ্ক রোড-লাবণী মোড় সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ; রামু-ফতেখাঁরকুল-মরিচ্যা জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্তকরণ; টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ জেলা মহাসড়কের হাড়িয়াখালী থেকে শাহপরীর দ্বীপ অংশ পুনর্নির্মাণ প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ; বাঁকখালী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন, সেচ ও ড্রেজিং প্রকল্প (প্রথম পর্যায়); শাহপরীর দ্বীপে সি ডাইক অংশে বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা।
এছাড়া উদ্বোধন করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ডারের পুনর্বাসন প্রকল্প, রামু কলঘর বাজার-রাজারকুল ইউনিয়ন সড়কে বাঁকখালী নদীর উপর ৩৯৯ মিটার দীর্ঘ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী সেতু, নবনির্মিত ছয়টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস ভবন, চারটি উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন (রামু, টেকনাফ, মহেশখালী ও উখিয়া), কক্সবাজার পৌরসভার এয়ারপোর্ট রোড আরসিসিকরণ ও অন্যান্য; শহিদ সরণি আরসিসিকরণ ও অন্যান্য; বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম সড়ক আরসিসিকরণ; নাজিরারটেক শুঁটকিমহাল সড়ক আরসিসিকরণ; টেকপাড়া সড়ক আরসিসিকরণ; সি বিচ রোড আরসিসিকরণ; মুক্তিযোদ্ধা সরণি আরসিসিকরণ; সৈকত-স্মরণ আবাসিক এলাকা সড়ক আরসিসিকরণ এবং আইনজীবী সমিতির নতুন ভবন নির্মাণ।
ভিত্তিপস্তর স্থাপন : প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প; কুতুবদিয়া উপজেলার ধুরং জিসি মিরাখালী সড়কে ধুরুংঘাটে ১৫৩ দশমিক ২৫ মিটার জেটি এবং আকবর বলী ঘাটে ১৫৩ দশমিক ২৫ মিটার জেটি নির্মাণ; মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা ঘাটে জেটি নির্মাণ; বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদ বরাবর পোল্ডারসমূহের (৬৭/এ, ৬৭, ৬৭/বি এবং ৬৮) পুনর্বাসন প্রকল্প।