নিখোঁজ হওয়ার রাতেই শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র ফারদিন নুর পরশকে। হত্যার পর সিদ্ধিরগঞ্জের লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের পেছনে শীতলক্ষ্যা নদীতে তার লাশ ফেলে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ২৫ বছরের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে ফারদিনের পরিবারের।
ফারদিনের লাশের সঙ্গে তার মোবাইল, ব্লুটুথ, মানিব্যাগ, ঘড়ি মেলায় এটি নিছক কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল না, বরং পরিকল্পিতভাবেই ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। তবে তাকে ঘটনাস্থলে কৌশলে নিয়ে আসা হয়েছিল নাকি অপহরণ করা হয়েছিল সেই নেপথ্যের কারণ ও খুনির সন্ধানে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নিহত ফারদিনের মাথার পুরো অংশে ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। তারা নিশ্চিত করেছেন, ৩ দিন আগেই অর্থাৎ শুক্রবার রাতেই হত্যা করা হয়েছিল ফারদিনকে।
ইতোমধ্যেই নিহত ফারদিনের চাচাতো ভাই সাইফুল ও ফারদিনের এক বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। কে সেই বান্ধবী, তার নাম কি, সে ব্যাপারে তদন্তের স্বার্থে কোনো তথ্য দিচ্ছে না পুলিশ।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়ার আগপর্যন্ত ফারদিনের সঙ্গে রামপুরা এলাকার একটি সিসিটিভির ফুটেজে যে মেয়েটিকে দেখা গিয়েছিল, সেই হতে পারে এই বান্ধবীটি।
আরও জানা গেছে, এই নাম না জানা বান্ধবীর সঙ্গে শুক্রবার বিকেল থেকে একসঙ্গেই ছিলেন ফারদিন।
এদিকে মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতাল এলাকায় ছেলেকে হারিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে শোক করতে দেখা গেছে নিহত ফারদিনের পিতা সাংবাদিক কাজী নূর উদ্দিন রানাকে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা স্বজন ও ফারদিনের সহপাঠীরা তাকে সমবেদনা জানানোর যেন ভাষা পাচ্ছিলেন না। কিছুতেই যেন কান্না থামছিল না সন্তান হারানো এই পিতার।
নিজেকে সামলে একপর্যায়ে গণমাধ্যমের সামনে নুর উদ্দিন রানা আর্তনাদ জানিয়ে বলেন, আগামী মাসেই (ডিসেম্বরে) ওয়ার্ল্ড ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার কথা ছিল ফারদিনের। ডিবেটিংয়ে ফারদিন খুব ভালো ছিল। তার পাসপোর্ট রেডি হয়েছে, স্পেন যাওয়ার কথা ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, শত্রুতার কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। ওর লাশের সঙ্গে মানিব্যাগ, ব্লুটুথ, অকেজো মোবাইল, ঘড়ি সবই পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। তিনিও সন্তানের মা, তিনি বোঝেন, সন্তান হারালে কীভাবে একটা পরিবারের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মেধাবী ছাত্রদের এভাবে মেরে ফেললে দেশের ভবিষ্যৎ কি দাঁড়াবে? ২৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন আমার, আজ হত্যাকাণ্ডের শিকার।
ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার নয়ামাটি এলাকায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ফারদিন। তার মেজো ভাই আবদুল্লাহ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
নিহত ফারদিনের বাবা নুর উদ্দিন রানা ঘটনার বিবরণ জানিয়ে বলেন, শনিবার বুয়েটে ফারদিনের পরীক্ষা ছিল। শুক্রবার বিকাল সোয়া ৩টার দিকে সে বাড়ি থেকে বের হয়। রাতে বাসায় অথবা বুয়েটের হলে গিয়ে থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু রাত সোয়া ১১টার পর থেকেই তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। শনিবার ফারদিন পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় এবং মোবাইল বন্ধ থাকায় তার সহপাঠী, শিক্ষকরা বুঝতে পারেন ফারদিন নিখোঁজ। আমরাও ফারদিনকে খোঁজা শুরু করি। এক পর্যায়ে ফারদিনের মোবাইলের শেষ অবস্থান দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় রামপুরা এলাকার একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা মিলে ফারদিনের। তাকে শেষবার দেখা যায় রামপুরা (ব্রিজের পাশে, ট্রাফিক পুলিশ বক্সের একটু আগে), শুক্রবার রাত ১০.৪৫ থেকে ১১.০০ টার মধ্যে। সেখানে ফারদিন তার সঙ্গে থাকা এক বান্ধবীকে নামিয়ে দেয়ার কয়েক মিনিট পর থেকেই তার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর রামপুরা থানায় এ ব্যাপারে ছেলে নিখোঁজের জিডি দায়ের করি।
রানা আরও জানান, আমার ছেলে একই সঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষ ৩টি বিদ্যাপীঠে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। সে বুয়েটে ভর্তি হলেও আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কারণে সে হলে থাকতে চাইতো না। বাসাতেই থেকে ক্লাস করতো। ফারদিন ডিবেটিং ক্লাব সহ নানা ধরনের সোশ্যাল ওয়ার্কের (সমাজ সেবা) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তবে সে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিল না। ফারদিন টিউশনি করতো, বাসায় সে তার ভাইদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করতো। তার মতো প্রাণবন্ত ছেলের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। আমি আমার সন্তানকে ফিরে পাব না। বিচার হোক, এটি আমরা চাই। মেধাবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে, এটা বন্ধ হোক।
এদিকে মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ ফরহাদ, ডা. মফিজউদ্দিন নিপুন ও ডা. গোলাম মোস্তফার সমন্বিত বোর্ড ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন।
দুপুর ১২টায় বোর্ডের প্রধান ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার রাতেই ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে আসে। তার মাথায় এবং বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সেই আঘাত কোনো ধারালো অস্ত্রের নয়। তিনদিন আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। আঘাতের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি হত্যাকাণ্ড। পুলিশের চাহিদা ও অধিকতর তথ্যের জন্য ভিসেরা সংগ্রহ করে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পেলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে তাকে কিভাবে মারা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জমান বলেন, গতকাল খবর পেয়ে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে এটি জোয়ারে ভেসে এসেছে। লাশটি ২-৩ দিন আগের হওয়ায় তা পচে ফুলে গিয়েছিল। আমরা সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে মর্গে দিয়েছি।
অপরদিকে ফারদিনের নিখোঁজ হওয়ার সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্তকারী রামপুরা থানার এসআই জিহান জানান, আমরা জিডি তদন্ত করেই সিসিটিভির ফুটেজ পেয়েছিলাম। তবে তার মোবাইল লোকেশন কোথায় কোথায় ছিল, শেষ কোথায় ছিল এসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, বিষয়টি এখন মামলায় রূপান্তর হবে এবং আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা হবে।
এদিকে নিহত ফারদিন নুর পরশের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটে। সেখানে ফারদিনের সহপাঠী, শিক্ষার্থী, শিক্ষকরা জানাজায় অংশ নেন এবং হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায়। ফারদিনের বাবা নুর উদ্দিন রানা জানান, ফারদিন এই এলাকাতেই বড় হয়েছে, স্কুলে পড়েছে। তাই এখানে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি জানান, মঙ্গলবার বাদমাগরিব পৈতৃক বাড়ি ফতুল্লার দেলপাড়ার নয়ামাটি এলাকায় শেষ জানাজার পর তাকে দাফন করা হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নুর পরশ গত শুক্রবার বিকাল সোয়া ৩টার দিকে ডেমরা থানার কোনাপাড়া বাসা থেকে বুয়েটে তার আবাসিক হলের উদ্দেশে বের হন। পরের দিন শনিবার সকালে তার পরীক্ষা ছিল। তবে তিনি পরীক্ষায় অংশ নেননি। ওই দিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলের পেছনে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করা হয়।