৩২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে

Budget-Logo-samakal-5ed2b68dc9a63

করোনাভাইরাসে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলায় আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ঢেলে সাজানো হবে স্বাস্থ্য খাত। অর্থ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য খাতে বর্তমানে জিডিপির ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ৪ শতাংশ করার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনাসহ স্বাস্থ্য খাতে আমূল সংস্কারের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, করোনা মোকাবিলায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ল্যাবরেটরি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ, আইসিইউ ইউনিট বাড়ানো, স্থলবন্দরে মেডিকেল সেন্টার স্থাপনসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা থাকছে আসন্ন বাজেটে। এ জন্য বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ৩২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি রোগী থাকে। কিন্তু চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী কয়েক গুণ কম। ফলে সারাদেশে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি করুণ। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের হার দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে কম।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলে মোট বাজেট ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। এর ৬৫ শতাংশই ব্যয় হয় বেতন-ভাতায়। বাকিটা উন্নয়নে। অথচ ভারতে স্বাস্থ্যে দেওয়া বরাদ্দ সে দেশের জিডিপির আড়াই শতাংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি খরচ করে।

জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (এসকাফ) ২০১৮ সালের জরিপে বলা হয়েছে, জিডিপি অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলে ৩২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে। প্রস্তাবিত এই বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেট ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, পরিচালন ব্যয় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।

বাজেটে যা থাকছে : আসন্ন বাজেটে আরও ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত নতুন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব থাকছে। এ জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকছে। করোনা প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড ও সচেতনতা বাড়াতে পরিবারকল্যাণ বিভাগকে বাড়তি ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, করোনা চিকিৎসায় পৃথক আইসোলেশন ইউনটি চালু, সুরক্ষা সামগ্রী আমদানি বাড়ানো, প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।

জানা যায়, শুধু করোনাকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় তিনটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার দুটি প্রকল্প রয়েছে। এশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ও কোরিয়া সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। জানা যায়, এসব প্রকল্পের আওতায় ১০টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পাঁচটি সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতাল ও চারটি বিশেষায়িত হাসপাতালের ল্যাবরেটরি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করা হবে। ফলে করোনা শনাক্তকরণ সহজ ও দ্রুত হবে।

করোনা সংক্রমণ রোধে দেশের সক্রিয় ২৬টি স্থলবন্দরে মেডিকেল সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সার্জিক্যাল মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি, ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষণে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আসন্ন বাজেটে।

যোগাযোগ করা হলে সাবেক অর্থ সচিব ও বর্তমানে কম্পট্রোলার অডিটর জেনারেল (সিএজি) মুহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম। এ খাতে অবকাঠামো ও গবেষণায় দুর্বলতা প্রকট। দুর্নীতিও একটা বড় সমস্যা। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য খাতকে প্রাধান্য দিয়ে বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সরকার গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য ডাক্তার শাহ মনির হোসেন বলেন, কভিড-পরবর্তী জনস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে এ খাতে অবকাঠামো শক্তিশালী ও মানবসম্পদের ঘাটতি পূরণ করতেই হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১১ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডাক্তার ইহতেশামুল হক বলেন, জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই। এটা কমপক্ষে জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। করোনা-পরবর্তী স্বাস্থ্য বাজেটকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন তিনি। স্বাস্থ্যনীতিতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য বাজেট হবে জিডিপির ৪ শতাংশ।

সংস্কারের পরামর্শ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবার তিনটি স্তর আছে- প্রাথমিক, মধ্যম ও তৃতীয় পর্যায়। এ তিনটি স্তরে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাথমিক স্তর তথা উপজেলা ও ইউনিয়ন হবে মূল লক্ষ্য। এখানে সরকারি ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। জেলা পর্যায়ে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে যেসব হাসপাতাল ও কলেজ রয়েছে, সেগুলোকে ভিন্ন আঙ্গিকে সংস্কার করতে হবে। এসব হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যেতে পারে।

গবেষণা খুবই দুর্বল। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। পুরোনো কাঠামো ভেঙে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডাক্তার মাহবুব-ই-রশিদ বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে হবে। বাজেটে টাকা বরাদ্দের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পুরোনো মডেলের। এটা দিয়ে দেশের জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ সম্ভব নয়। সংস্কার অবশ্যই করতে হবে।

Pin It