প্রতি বছর ১২ নভেম্বর যখন আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে তখন স্মৃতির পাতায় ’৭০-এর প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ের ছবি ভেসে ওঠে, যে জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু ঘটে। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়; অনেকে আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাইবোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি আমাকে আবেগাপ্লুত করে। সেদিন ভয়ংকর সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। কারণ আমরা ছিলাম পরাধীন, পাকিস্তানের অধীন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ না করলে আজ হয়তো আমাদের অবস্থা হতো রোহিঙ্গাদের মতোই।
’৭০-এর ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক তত্পরতার ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহূত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি। সে সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সকল এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিব।’ এই কথাটা ভীষণভাবে আমার হূদয়কে আলোড়িত করে। ’৭০-এর ২ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে—তখন ভোলায় রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না—ব্যাপকভাবে গণসংযোগ চালাই। প্রতি মাসে ভোলা যাই, গণসংযোগ ও জনসভা করি। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ নির্বাচন যখন ঘনায়মান, তার ২৫ দিন আগে ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয় দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত। ১২ নভেম্বরের তিন-চার দিন আগ থেকে বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেছি। ১০ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমুদ্দীনে এবং ১১ তারিখ লালমোহনে মঙ্গল শিকদারে জনসভা করতে যাই। সেখানে জনসভায় যখন বক্তৃতা করছি তখন শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড ঝড়। জনসভা শেষে প্রবীণ নেতৃবৃন্দসহ জিপে ভোলায় ফিরে আসি।
১২ তারিখ জনসভা ছিল তজুমুদ্দীনের দাসের হাট। যখন শাহজাদা ভাইয়ের জিপে করে দৌলত খাঁ হয়ে—তখন দৌলত খাঁ হয়ে তজুমুদ্দীনে যাওয়া যেত—রওনা করেছি, তখন দৌলত খাঁ যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। সবাই জনসভায় যেতে নিষেধ করল। কিন্তু আমি তো রিকশা করে মাইক পাঠিয়েছি। আমার লোক চলে গেছে দাসের হাটে। আমার মা সংবাদ পেয়ে—শ্রদ্ধেয় মা যিনি আমার জীবনের প্রেরণার উত্স—নিষেধ করলেন আমি যেন জনসভা বাতিল করি। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। মধ্যরাতে শুরু হয় তুমুল ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। সকালবেলা নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশাহারা হয়ে গেলাম। স্মৃতির পাতায় আজও ভাসে শিবপুর ইউনিয়নের রতনপুর বাজারের পুকুরপাড়ে শত শত লোককে দাফন করার সেই করুণ দৃশ্য! এত মৃতদেহ দাফন করে কুলাতে পারছি না। চারিদিকে মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। শিবপুর ইউনিয়নে একটা বাড়ি, যেখানে ৯০ জনের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র তিন জন। যখন তজুমুদ্দীনের খবর পাই তখন শুনি ৪০ শতাংশ লোকের মৃত্যু হয়েছে। যে দাসের হাটে জনসভা করার কথা ছিল সেখানে কিছুই নেই।
আমার মাইক বহনকারী মৃত্যুবরণ করেছেন। দাসের হাটে বড় বড় ব্যবসায়ী সবাই সর্বস্বান্ত। বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচনি গণসংযোগে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে লোক মারফত টাকাসহ বার্তা পাঠালেন, আমি যেন সর্বত্র দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শুকনো খাবার বিশেষ করে চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দিই এবং বলেছেন, “তুই দুর্গত এলাকার প্রত্যেকটা জায়গায় ক্যাম্প কর এবং লিখে রাখ ‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’। অনেক মানুষ রিলিফ নিয়ে যাবে কিন্তু এই দুর্গত অবস্থায় তারা মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছাতে পারবে না। কিছুটা বিলি করে বাকিটা তোর কাছে দিয়ে আসবে। তুই সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিবি।” হয়েছেও তাই। ১২ নভেম্বরের পর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাওয়ার পানি, শুকনো খাবার, কেরোসিন তেল পৌঁছে দিয়েছি।
হাবিবুর রহমান তালুকদার নামে একজন পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ ছিলেন। তার একটি লঞ্চ ছিল। সেই লঞ্চে নদীর পাড়ে পাড়ে মানুষের সেবা করেছি। যখন রাস্তা দিয়ে যেতাম, হাটবাজার ভেঙে মানুষ ছুটে আসত। মানুষের জন্য কাজ করলে মানুষ তার যে প্রতিদান দেয় সেদিন তা হূদয় দিয়ে অনুভব করেছি। ১৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ভোলায় এলেন। সেখান থেকে লঞ্চে করে বঙ্গবন্ধুকে আমরা দুর্গত এলাকায় নিয়ে গেলাম। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, লাখো মানুষের মৃতদেহ আর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। যখন মনপুরায় গেলাম, দেখি বহু লোকের ভিড়ে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। পরনে স্রেফ একটা লুঙ্গি। লঞ্চ থেকে নেমেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি প্রিয় শাহজাদা ভাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে আদর করলেন। লঞ্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট ছিল, সেগুলো তিনি শাহজাদা ভাইকে দিলেন। ফেরার সময় নদীর পাড়ে লাখ লাখ লোকের মৃতদেহ দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আর আমার পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভব নয়! আমাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দাও।’ যে বিশেষ লঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভোলা গিয়েছিলেন সেই লঞ্চে ঢাকা ফিরে এলেন। উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি-সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।
স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম যান ভোলা। ’৭০-এ তিনি দেখে এসেছিলেন জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত ভোলা। ১৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসে সবই ভেসে গিয়েছিল। যে জায়গায় বেড়িবাঁধ ছিল না, সেই স্থানকে জিরো পয়েন্ট বলতাম। সেখান দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করেছে এবং নিমেষে সব তলিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ছোট্ট একটি হেলিকপ্টারে করে ভোলা এসেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। ভোলায় সেই জিরো পয়েন্টে বঙ্গবন্ধু মাটি কেটে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ভোলা থেকে রামগতি গিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্বোধন করেছেন। আজকে বেড়িবাঁধ দিয়ে আমরা জলোচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করি, ঘূর্ণিঝড় হলে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় গ্রহণ করি। আগে এই সাইক্লোন শেল্টারকে বলা হতো ‘মুজিব কেল্লা’। এটা বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু চর কুকরিমুকরি গেছেন, সাইক্লোন শেল্টার করেছেন, জনসাধারণকে ডিপ টিউবওয়েল দিয়েছেন, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন করেছেন, যেটা আজ ফরেস্ট হয়েছে। এসব বঙ্গবন্ধুর অবদান। বঙ্গবন্ধু ভোলাকে খুব পছন্দ করতেন। মনপুরায় তিনি ‘চিন্তানিবাস’ নামে একটি আবাসস্থল করতে চেয়েছিলেন। তার কাজও শুরু হয়েছিল। বসরতউল্লাহ সাহেব একটি দীঘি কেটে মাটি ভরাট করে কাজটি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন যুগোস্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলাম তখন দেখেছি মার্শাল টিটো একটা দ্বীপে থাকতেন। দ্বীপটার নাম ছিল ‘ব্রিওনি’। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু মনে করলেন ভোলার একটি দ্বীপে এরকম আবাসস্থল করবেন, যেখানে বিদেশিরা গেলে তাদের সঙ্গে মিটিং হবে। তিনি এটা করে যেতে পারেননি। মনপুরায় অবকাশ যাপন কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। আলী মিয়া মাস্টার ছিলেন মনপুরার চেয়ারম্যান। তিনি আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন। তার পরিবারে ২৭ জন সদস্য ছিল। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর তিনি একাই বেঁচে ছিলেন। কত প্রিয় মুখ আমি হারিয়েছি। যার সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছে পরদিন তাকে পাইনি। ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রামগতি, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এই ক্ষতি পূরণ হবার নয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি পোস্টার হয়েছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এই পোস্টারটিতে ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথা ব্যক্ত হয়েছিল। দুটো ঘটনা বাংলার মানুষকে পথ দেখিয়েছে। এক, ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, যখন আমরা ছিলাম ‘অরক্ষিত’; আর ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, যখন আমরা ছিলাম ‘অসহায়’। বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়, যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার যে ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা এখন সারা বিশ্বের জন্য মডেল। বাংলাদেশে এখনো প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো, এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা।
তোফায়েল আহমেদ
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য;
সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ