ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা গেলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরও দেড় গুণ বাড়ানো সম্ভব। শুল্ক ও অশুল্ক বাধার পাশাপাশি রাজনৈতিক আস্থাহীনতার কারণে দুই দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া সড়ক-রেলপথ যোগাযোগ, বন্দর সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো অসুবিধা তো আছেই।
শুধু সহায়ক পরিবেশ না থাকায় ভারতের সঙ্গে বছরে ৯৯২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বাণিজ্য সম্ভাবনা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমান বাজারদরে যার পরিমাণ ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বছরে মাত্র ৬২২ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই বাণিজ্য বাড়িয়ে ১ হাজার ৬৪৪ কোটি ডলার করা সম্ভব।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘এ গ্লাস হাফ ফুল, প্রমিজ অব রিজিওনাল ট্রেড ইন সাউথ এশিয়া’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এই বিপুল বাণিজ্য সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে শুল্ক বাধার চেয়ে অশুল্ক বাধা বেশি। দুই দেশের পণ্যের চালান সীমান্ত পেরোতে নানা ধরনের জটিল শুল্ক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। যেমন ট্রাক বদল করতে হয়, অনেক পণ্যের পরীক্ষা করতে হয়। তাই বাণিজ্য বাড়াতে হলে এ ধরনের প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে হবে। তিনি বলেন, এসব বাধা দূর করতে উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে সদিচ্ছা নেই, তা নয়। ওপরের সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে প্রতিফলন হয় না। বহুদিন ধরে এ ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করার বিষয়গুলো অবহেলিত হয়ে আছে।
জাহিদ হোসেন মনে করেন, সার্কের আওতায় অবাধ বাণিজ্য আটকে গেছে। তাই দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারত, নেপাল, ভুটানের মতো দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা উচিত। বিতর্ক আছে, আগে আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা হবে নাকি ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ার মধ্যেই অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্য সুযোগ হারানোর বিষয়টিও উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বছরে প্রায় ৫৪ কোটি ডলার এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ৪২ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্যের সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য সম্ভাবনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্ভাবনা প্রায় ১৫ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। সার্বিকভাবে এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বছরে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বাণিজ্য হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, এটি বাড়িয়ে ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা সম্ভব।
তাহলে বাণিজ্য বাড়াতে সমস্যা কোথায়, এই প্রশ্নের উত্তরও মিলেছে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংক সোজাসাপ্টা বলেছে, এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে অনেক বেশি খরচ। যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানভুক্ত দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য করতে ব্যবসায়ীর যত খরচ হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশের ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করতে তার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়। একইভাবে উত্তর আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় তিন গুণ বেশি খরচ করতে হয় দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়ীদের।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই নিজেদের স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় আমদানি ঠেকাতে সংবেদনশীল পণ্যের তালিকা তৈরি করে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ ধরনের সংবেদনশীল পণ্যের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য কমে যায় এক-তৃতীয়াংশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ বাণিজ্য করে থাকে। অন্যদিকে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে অর্ধেক বাণিজ্য করে। আর সাব সাহারার দেশগুলো করে ২২ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সিংহভাগ বাণিজ্য নিজেদের মধ্যে। বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হলো পার্শ্ববর্তী কানাডা ও মেক্সিকো।