কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যুর ঘটনায় আদালতে হত্যা মামলা করেছে তার পরিবার।
তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে বুধবার টেকনাফের বিচারিক হাকিম আদালতে এই মামলা দায়ের করেন।
টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলি এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ মোট নয় পুলিশ সদস্যকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাদী।
বিচারক তামান্না ফারাহ মামলাটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছ র্যাবকে।
শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আদালতে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. মোস্তফা। মামলা করার পর শারমিন আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “দেশের একজন বীর সন্তানকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার বিচারের জন্য আমরা কেইস ফাইল করতে এসেছি এবং কেইস ফাইল করেছি।”
শারমিন বলেন, পুলিশের গুলিতে তার ভাইয়ের মৃত্যু হয় ৩১ জুলাই রাতে। সেই রাতে টেকনাফ থেকে পুলিশ ফোন করে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান তার ছেলে কি না, তিনি সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন কি না। কিন্তু পুলিশ তখন বলেনি যে সিনহার মৃত্যু হয়েছে।
“পরদিন বাসায় তিনজন পুলিশ গিয়েছিলেন, তারাও বলেননি যে আমার ভাই মারা গেছেন। আমরা পরে অন্য সোর্সে জেনেছি।”
( অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান )
দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা মো. রাশেদ খান ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে।গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।
ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
তবে ঘটনার যে বিবরণ পুলিশ দিয়েছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। রাশেদ আদৌ অস্ত্র তাক করেছিলেন কি না, তা নিয়ে যেমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তেমনি পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিতে দুই ঘণ্টা দেরি হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। যিনি সেদিন গুলি ছুড়েছিলেন, সেই পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ২০ পুলিশ সদস্যকে ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সিনহার মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন বলে সরকারপ্রধানের দপ্তর থেকে জানানো হয়।
আসামি কারা
মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলিকে, যিনি সিনহাকে গুলি করেছিলেন।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয়েছে ২ নম্বর আসামি। এজাহারে বলা হয়েছে, গুলি করার আগে লিয়াকত তার সঙ্গে ফোনে পরামর্শ করেছিলেন। ওসির ‘প্ররোচনা ও নির্দেশনাতেই’ লিয়াকত ঠাণ্ডা মাথায় সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন। পরে প্রদীপ ঘটনাস্থলে গিয়ে সিনহার ‘মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পায়ের জুতা দিয়ে আঘাত করে’ বিকৃত করার চেষ্টা করেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে টেকনাফ থানার এসআই দুলাল রক্ষিতকে, যিনি সিনহার মৃত্যুর পর মাদক ও অস্ত্র আইনে মামলা করেন।
এছাড়া বাকি ছয় আসামি হলেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল এবং কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ‘ইচ্ছাকৃত নরহত্যা’, ২০১ ধারায় আলামত নষ্ট ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি এবং ৩৪ ধারায় পরস্পর ‘সাধারণ অভিপ্রায়ে’ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে (২১) মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়।
এছাড়া আটজন স্থানীয় বাসিন্দা এবং আইয়ুব আলী নামে একজন সার্জেন্টকে সাক্ষী করা হয়েছে এ মামলায়।
( ওসি প্রদীপ কুমার দাশ )
কী অভিযোগমামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সিনহা ও সিফাত ৩১ জুলাই বিকালে ডকুমেন্টারির জন্য ভিডিও ধারণ করতে নীলিমা রিসোর্ট থেকে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রাস্তার পাশের পাহাড়ে যান। ‘ডকুমেন্টারির প্রয়োজনেই’ সিনহার পরনে তখন কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট ছিল।
রাত ৮টা পর্যন্ত পাহাড়ে ভিডিও ধারণ করে তারা ফিরতি পথে রওনা হন এবং রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে সিনহার প্রাইভেট কার শামলাপুর চেক পোস্টে পৌঁছায়। পরিদর্শক লিয়াকতসহ পুলিশ সদস্যরা সেখানে গাড়ির ‘গতিরোধ’ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়।
এজাহারে বলা হয়েছে, সিনহা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হিসেবে পরিচয় দিলে পুলিশ সদস্যরা গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে ‘টেনেহিঁচড়ে’ সিফাতকে বের করে নিয়ে যান। সিফাত তখন দুই হাত তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন।
“আসামিরা ওই সময় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে।”
মামলায় বলা হয়েছে, এ সময় সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত উপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দেন। কিন্তু পরিদর্শক লিয়াকত তাকে উদ্দেশ করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থঅকেন।
“বলতে থাকেন, ‘তোর মত বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু’। এরপর লিয়াকত টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন করে নিচুস্বরে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে লিয়াকত ফোনে প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছ ‘।
“ওই সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরিদর্শক লিয়াকত সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের শরীরের উর্ধ্বাংশে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান এবং নিজের জীবন রক্ষার জন্য ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। লিয়াকত আলি তখন সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরও এক রাউন্ড গুলি করেন।”
এজাহারে বলা হয়, “এর পরপর ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে ওসি প্রদীপ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং নিজের বুট জুতা দিয়ে ঘষা দিয়ে নিহতের মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন।”
পুলিশ সদস্যরা এ সময় মামলার সাক্ষী এবং ঘটনাস্থলের আশপাশে উপস্থিত লোকজনকে ‘অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে’ সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপর রাত পৌনে ১২টার দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়।