২৮ বছর পর ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ স্বপ্ন ডানা মেলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

Untitled-13-5c3e39bb0b6cb

টানা ২৮ বছর পর দেশের ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ হিসেবে খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ (ডাকসু) নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছেন ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। আগামী ৩০ মার্চ এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোটার তালিকা তৈরির কাজও প্রায় শেষ। এজন্য একটি ডাটাবেজও তৈরি হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণির নিয়মিত ছাত্রছাত্রীরাই এ নির্বাচনের ভোটার হবেন। এমফিল, পিএইচ.ডি এবং কোনো সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার হবেন না। সংসদে নতুন কিছু পদও যুক্ত হতে চলেছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রীকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক এবং কমন রুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদ যুক্ত করার। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তিন সদস্যের একটি কমিটি কাজ করছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বর্তমানে ক্যাম্পাসে অনুকূল পরিবেশ রয়েছে বলে বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন অভিমত দিয়েছে। অবশ্য কোনো কোনো সংগঠনের অভিমত, ক্যাম্পাসে বর্তমানে সহাবস্থান করার মতো পরিবেশ নেই। নির্বাচন করতে হলে সহাবস্থান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এক সময় বলা হতো, ডাকসু ভবিষ্যতের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির ‘সূতিকাগার’। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ডাকসু। কারণ, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সংগঠন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, গণতান্ত্রিক  শাসনামলেও গত ২৮ বছর ৫ মাস ধরে ডাকসুর কোনো কার্যক্রম নেই। স্বাধীন দেশে গত ৪৭ বছরে এ নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ডাকসুর দ্বিতীয় নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের কারণে বাতিল হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এর দীর্ঘ আট বছর পর ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ২৮ বছরেও সেই নির্বাচন আর হয়নি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমিতির মতো বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নির্বাচন প্রতি বছর নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠনে ডাকসুসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কারণ ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিটি ছাত্র সংগঠন সংগঠিত হতো, শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে ছাত্রনেতারা নিজেদের নেতৃত্ব দানের এবং সকল শ্রেণিপেশার মানুষের আস্থা অর্জনের উপযোগী করে তুলতেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে। দুই যুগ ধরে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাস ও হলে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করছে।

সিনেটে-সিন্ডিকেটে ছাত্র প্রতিনিধি নেই :স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোর সবচেয়ে উপরের স্তরে রয়েছে সিনেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণ, আইন বাতিল ও সংশোধনের ক্ষমতা রয়েছে সিনেটের। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এ সিনেটে নির্বাচিত ডাকসু থেকে ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা। তা নেই ২৮ বছর ধরে। আছেন শুধু উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সরকার কর্তৃক মনোনীত কর্মকর্তা, স্পিকার মনোনীত সংসদ সদস্য, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রমুখ।

ডাকসু না থাকায় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিও নেই সিনেটে। এর ফলে সিনেটে একচেটিয়া ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাবাণিজ্য, অস্বাভাবিক শিক্ষা ব্যয়, হলগুলোতে দখলদারিত্ব ও সিটবাণিজ্য, শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশের অবনতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত সকল প্রকার সহ-শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এই কার্যকর প্ল্যাটফর্মটিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক অভিমত জানাতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন অপরাজনীতিতে। ফলে গড়ে উঠছে না ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোর দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে সিন্ডিকেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদ এটি। শিক্ষক এবং সরকারি কর্মকর্তারা এ পরিষদের সদস্য। কিন্তু সিনেটে আইন দ্বারা পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধির ভূমিকা নিশ্চিত করা হলেও সিন্ডিকেটে সে সুযোগ একদমই রাখা হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্রদের অংশীদারিত্ব নেই আড়াই যুগের বেশি। এদিকে নির্বাচন না হলেও প্রতিবছর ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদের জন্য ঢাবির শিক্ষার্থীদের থেকে কর্তৃপক্ষ ১২০ টাকা ফি নিয়ে থাকে। প্রতি বছর ডাকসুর ফান্ডে প্রচুর অর্থ জমলেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে অন্য খাতে।

বিশিষ্টজনের অভিমত :শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ডাকসু না থাকাতেই ছাত্র রাজনীতিতে অছাত্ররাও ঢুকে পড়েছে। অথচ এ নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির দিতে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও ডাকসু নির্বাচনকে বার্ষিক হিসেবে দেখা উচিত। এ জন্যে সরকারের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়।

সাবেক উপাচার্য, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কারখানা, তেমনি ডাকসু রাজনীতিক তৈরির কারখানা। ডাকসুর মধ্য দিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের অংশীদারিত্ব গড়ে উঠত। শুধু ঢাকা নয়- সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই ছাত্র সংসদ গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে রাখতে হলে ডাকসুসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে হবে। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মূলত জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতির ‘স্টেজ রিহার্সাল’ হয়ে থাকে। পাশাপাশি এর নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও রয়েছে। তাই ২৮ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়া দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক। ঢাবির বর্তমান প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ায় তাদের তিনি ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তিনি তার অধিভুক্ত সকল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেন, ডাকসুর মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা হয়। তরুণদের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য এ নির্বাচনের বিকল্প নেই।

আদালতের কারণে খুলল জট :উচ্চ আদালতে করা দুটি রিট আবেদনের কারণে দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচনের জট খুলেছে এবার। ২০১২ সালের ২১ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন ঢাবির ২৫ শিক্ষার্থী। একই বছরের ৮ এপ্রিল এই রিটে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এরপর গত বছরের ১৭ জানুয়ারি রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।

এরপরেও রায় অনুসারে নির্বাচন সম্পন্ন না করায় ঢাবি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গত সেপ্টেম্বরে আদালত অবমাননার আবেদন করেন রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন থেকে ছয় মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৫ মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে মর্মে হাইকোর্টকে চিঠি দিয়ে আবেদন দাখিল করে। তখন হাইকোর্টের সংশ্নিষ্ট বেঞ্চ আদালত অবমাননার আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এরপরও ১ অক্টোবর ঢাবি কর্তৃপক্ষ ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে।

পরে ওই দিনই চেম্বার আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। এর ধারাবাহিকতায় গত ৬ জানুয়ারি ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে থাকা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এর ফলে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে, সংশ্নিষ্টদের আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।

জেগেছে আশার আলো :আদালতের আদেশের পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী শাহরিন সুলতানা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেছে ডাকসু। এর বলিষ্ঠ অবদান রয়েছে দেশের প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে। সেই ডাকসু ফিরে আসছে, এটা পরম আনন্দের।

উইমেন স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আবু তাহের বলেন, নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া অবশ্যই শুভ। তবে এটি আসলেই কি হবে? হতে দেওয়া হবে? একই সংশয়ের কথা জানান লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদুল ইসলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদল সমর্থক এক ছাত্র বলেন, হলগুলোতে বর্তমানে সরকার দলীয় ক্যাডারদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। ছাত্রদলের কেউ তো হলে থাকা তো দূরের কথা, ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারে না। এ অবস্থায় হলগুলোতে ভোটকেন্দ্র না দিয়ে একডেমিক ভবনগুলোতে দিলে নির্বাচন স্বচ্ছ হবে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভগের ছাত্র আবু রায়হান খান বলেন, ডাকসু নির্বাচন সাধারণ ছাত্রদের বদলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শুভ হবে না।

ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী তৌসিফা ফারহাত বলেন, আশা করি, ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সচল কেন্দ্র্রীয় ছাত্র সংসদ পাব, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবে।

ছাত্রনেতাদের ভাবনা :ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সময় এসেছে ডাকসু ধারণা নবায়নের। নতুন দিনের একাডেমিক ঐতিহ্য বিনির্মাণের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হবে ডাকসুকে। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়াকে তারা গৌণ বিষয় মনে করেন, তাদের মূল লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।

ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিক্ষার্থীদের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। একদিকে স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ বজায় রাখার দাবি করা এবং অন্যদিকে পদ্ধতিগতভাবে ডাকসু নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা একটি বড় স্ববিরোধিতা। কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও ন্যূনতম নির্বাচন সহায়ক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকায় ছাত্র রাজনীতি সন্ত্রাস ও পেশীনির্ভর রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাশাপাশি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ও নেতৃত্ব নির্বাচন করার অধিকার এবং বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কথা বলার ও তাদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এমন কোনো নির্বাচিত কাঠামো নেই, যেটি শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহির ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ায় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে এখনও তারা পুরোপুরি নিশ্চিত নন।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ঢাবি শাখার আহ্বায়ক উলুল আমর অন্তর বলেন, আদালতের হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবারও ডাকসু নির্বাচন দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবেন বলে আশা করছি।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ২৮ বছর বন্ধ থাকার পর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিশ্চয়ই আশান্বিত করে। তবে ক্যাম্পাস এবং হলগুলোতে এখন ভয়-ভীতি ও দখলদারিত্বের পরিবেশ পুরোমাত্রায় বিরাজ করছে। অবাধ ও ভীতিহীন পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে এ নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

ডাকসুর সাবেক নেতারা যা ভাবছেন :ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম। যারা এত বছর শিক্ষার্থীদের অধিকার বঞ্চিত করেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। দেরি না করে দ্রুত ডাকসু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ একাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।’

ডাকসুর সাবেক ভিপি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঢাবি কর্তৃপক্ষের এ উদ্যোগ যেন লোকদেখানো উদ্যোগে পরিণত না হয়।

ডাকসুর সাবেক ভিপি, গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, দুর্ভাগ্যজনক যে সামরিক সরকারের আমলে ডাকসু নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক আমলে বহু বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। এ নির্বাচন ছাত্রদেরই আদায় করে নিতে হবে।

উপাচার্যের ভাষ্য :উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ডাকসু নির্বাচনের জন্য নানা প্রক্রিয়া চলছে। এক বছর আগে থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি। শিক্ষার্থীদের জন্য ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এতে ভোটার তালিকাও হয়ে গেছে। প্রতিবছরই তাই এই ডাটাবেজ কাজে লাগবে। প্রশাসনিক সব কাজে এটি লাগবে। এটি একটি বড় কাজ হয়েছে।

উপাচার্য বলেন, ডাকসুর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা সাপেক্ষে যুগোপযোগী করার জন্য কমিটি গঠন হয়েছে। তাদের সুপারিশমতো গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিশীলন করা হবে। তবে এটাই চূড়ান্ত নয়। ভবিষ্যতেও প্রয়োজন হলে এতে সংযোজন-বিয়োজন করা যাবে। এ নির্বাচনের জন্য একটি নির্বাচনী আচরণবিধিও প্রণয়ন করা হবে। সেটিও এই কমিটি করবে। এর বাইরে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গেও মতবিনিময় হয়েছে। ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।

এত বছর পর নির্বাচন করা বর্তমান প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ কি না?- এ প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য বলেন, তা তো অবশ্যই। তবে সব দিক থেকে সুন্দর নির্বাচন করার চেষ্টাই হচ্ছে।

Pin It