মন্ত্রিসভা গঠন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের মতো এবার সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থী বাছাইয়েও চমক দেখাবে আওয়ামী লীগ। নতুন ও তরুণ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়েই চূড়ান্ত করা হবে প্রার্থী তালিকা। এতে বাদ পড়তে যাচ্ছেন সংরক্ষিত নারী আসনের অধিকাংশ পুরনো এমপি। সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে ক্ষমতাসীন দলে চলছে শেষ মুহূর্তের তৎপরতা। এবারের রেকর্ডসংখ্যক দেড় সহস্রাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থেকে প্রার্থী বেছে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। তিনি প্রার্থী চূড়ান্ত করার কাজ গুছিয়ে এনেছেন। একাধিক জরিপ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জনপ্রিয় আর ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। প্রার্থী চূড়ান্ত করতে আগামী ২৬ জানুয়ারি শনিবার দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক ডাকা হয়েছে।
দলীয় সূত্রমতে, দল ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেত্রীরা দলের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের অতীত আন্দোলন-সংগ্রামে ত্যাগ-তিতিক্ষাসহ নেতৃত্বের যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ত্যাগী ও রাজপথে সক্রিয়রাই অগ্রাধিকার পাবেন। এর বাইরে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা নারীদের কয়েকজনকেও এবার নারী এমপি হিসেবে দেখা যেতে পারে। জেলা কোটা সমন্বয় করে প্রার্থী মনোনীত করা হবে বিধায় অতীতে যেসব জেলা সংরক্ষিত নারী এমপিবঞ্চিত ছিল সেসব জেলাকে এবার অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বঞ্চিত এমন প্রায় ৩০টি জেলা থেকে এবার প্রার্থী মনোনয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
জাতীয় সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে ৪৩টি পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ২৫৭টি আসনের (একজন মারা যাওয়ায় আসনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫৬টি) বিপরীতে এই সংখ্যক আসন পাবে দলটি। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী একটি দল বা জোট ছয়টি বিজয়ী আসনের বিপরীতে একটি করে সংরক্ষিত নারী আসন পায়।
কয়েকজন নেতা জানান, দলের সংসদীয় বোর্ডের মাধ্যমে ওই ৪৩টি সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলেও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতেই মূলত প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব রয়েছে। শেখ হাসিনা নিজেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিগত জাতীয় সংসদগুলোতে যারা দলীয় মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই এবার বাদ পড়বেন। নতুনদের বেছে নেবেন তিনি। গণভবনে দেখা করতে আসা দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরাসহ দলীয় ফোরামের বৈঠকে শেখ হাসিনা এমন হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন, মনোনয়ন পেতে যারা লবিং-তদবির করবেন দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তাদের বিবেচনায়ই আনা হবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে, সংরক্ষিত নারী আসনে দলের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্যাগী এবং রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদেরই বেছে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সাংস্কৃ?তিক অঙ্গনের বেশ কয়েকজন এবার জাতীয় নির্বাচনে দলের পক্ষে ব্যাপক কাজসহ সারা?দেশে ভালো ভূমিকা রেখেছেন। এ জন্য তাদের কয়েকজনকেও মূল্যায়ন করা হবে।
গত ১৫ থেকে ২০ জানুয়ারি সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও জমা নেওয়ার কার্যক্রম চলে। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৫১৮ জন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন, যা নতুন রেকর্ড। আওয়ামী লীগের ভাগে পড়া ৪৩টি নারী আসনের বিপরীতে গড়ে একটি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনের বেশি।
আইন অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের জন্য দল ও জোটওয়ারী তালিকা তৈরি এবং ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে। আর গেজেট প্রকাশের নব্বই দিনের মধ্যে এ নির্বাচন শেষ করতে হবে ইসিকে। গত ১ জানুয়ারি ইসি থেকে গেজেট প্রকাশ হওয়ায় ২৯ মার্চের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। ইসি থেকে ইতিমধ্যে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে।
মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে যারা :দশম সংসদের সংরক্ষিত নারী এমপি পদে থাকা অনেকেই এবার সরাসরি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। তারা সংরক্ষিত নারী এমপি পদে অগ্রাধিকার পাবেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, শিরীন নাঈম পুনম, নাসিমা ফেরদৌসী, অ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা, সাবিনা আক্তার তুহিন, অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার, সেলিনা জাহান লিটা, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, মাহজাবিন খালেদ বেবী, ওয়াসিকা আয়েশা খান, নিলুফার জাফর উল্লাহ, রোকসানা ইয়াসমিন ছুটি এবং আক্তার জাহান।
এ ছাড়া গত সংসদের সংরক্ষিত নারী এমপি ন্যাপের আমেনা আহমদ, জাসদের লুৎফা তাহের এবং নবম সংসদের সংরক্ষিত এমপি গণতন্ত্রী পার্টির রুবী রহমান আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের মনোনয়নে এমপি হতে যাচ্ছেন বলে আলোচনা হচ্ছে।
দশম ও নবম সংসদের এমপিদের মধ্যে বরিশালের জেবুন্নেছা আফরোজ, মৌলভীবাজারের সায়েরা মহসীন ও কুষ্টিয়ার সুলতানা তরুণসহ কয়েকজন সংরক্ষিত এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে যুক্ত নারীনেত্রীদের মধ্যে ফরিদুন্নাহার লাইলী, ড. শাম্মী আহম্মেদ, শামসুন নাহার চাঁপা, ডা. রোকেয়া সুলতানা, পারভীন জামান কল্পনা ও মারুফা আক্তার পপি; সহযোগী সংগঠনের শীর্ষপদে থাকা নারী নেত্রীদের মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগের সাফিয়া খাতুন, মাহমুদা বেগম ক্রিক, শাহিদা তারেখ দীপ্তি, শবনম জাহান শিলা, সাবেরা বেগম ও নারগিস রহমান; যুব মহিলা লীগ থেকে নাজমা আক্তার ও অধ্যাপক অপু উকিল; মহিলা শ্রমিক লীগের রওশন জাহান সাথী এবং তাঁতী লীগের সাধনা দাশগুপ্তা সংরক্ষিত নারী এমপি পদের জোরালো দাবিদার। তবে একবারও ওই পদে না আসা ড. শাম্মী আহম্মেদ, শামসুন নাহার চাঁপা, ডা. রোকেয়া সুলতানা, পারভীন জামান কল্পনা, মারুফা আক্তার পপি, মাহমুদা বেগম ক্রিক, সাধনা দাশগুপ্তা এবং শবনম জাহান শিলার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে সূত্র জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার দলের কয়েকজন নেতা ও প্রয়াত নেতার স্ত্রীকেও সংরক্ষিত এমপি পদে নিয়ে আসতে পারেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা এ এইচ খায়রুজ্জামান লিটনের স্ত্রী শাহীন আক্তার রেনী, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের স্ত্রী ও ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাকিয়া পারভীন খানম, অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রয়াত এম এ আজিজের স্ত্রী রাবেয়া আজিজ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিলের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নিলুফার আনজুম পপি, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের প্রয়াত সভাপতি বজলুর রহমানের স্ত্রী শিরীন আখতার এবং বঙ্গবন্ধুর চাচাত ভাই শেখ হাফিজুর রহমান টোকনের স্ত্রী শেখ এ্যানি রহমান উল্লেখযোগ্য।
সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে প্রখ্যাত চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী, নাট্যাভিনেত্রী শমী কায়সার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নূজহাত চৌধুরীকে এবার সংরক্ষিত আসনে এমপি হিসেবে দেখা যেতে পারে। জেলা কোটায় ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মনিরা আক্তার মনি এবং ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব মমতাজ আক্তারী (আইভি মাসুদ) এর নামও জোরালো আলোচনায় রয়েছে।
সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ :এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যাপক আগ্রহ গণমাধ্যমসহ সর্বত্র তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এবার জনপ্রিয় চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী ও নাট্যাভিনেত্রী শমী কায়সার ছাড়াও দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী সুজাতা, আনোয়ারা, সাহানুর, ফারজানা আমিন নূতন, দিলারা ইয়াসমিন, অরুণা বিশ্বাস, মৌসুমী, অপু বিশ্বাস, জ্যোতিকা জ্যোতি, অভিনেত্রী ফাল্কগ্দুনী হামিদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান এবং মডেল ও সংবাদ উপস্থাপিকা জেনিফার ফেরদৌস।
আরও যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী : ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নির্যাতিত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা রানী শীল সংরক্ষিত আসনে এমপি পদে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছেন। বিভিন্ন জেলা কোটায় আরও মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছেন অধ্যাপক খালেদা খানম, জিনাতুন নেছা তালুকদার, আসমা জেরিন ঝুমু, আজিজা খানম কেয়া, চেমন আরা তৈয়ব, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, অ্যাডভোকেট রুবামা ইয়াসমিন নূর, শামীম সুলতানা, আসমা আকতার রুনা, বনশ্রী বিশ্বাস স্মৃতিকণা, শামসুন্নাহার রত্না, ঝর্ণা হাসান, শারমিন মৌসুমী কেকা, ব্যারিস্টার ওলোরা আফরিন, সুমনা আকতার লিলি, জেদ্দা পারভীন রিমি, জান্নাত আরা হেনরি, নাসরিন আকতার, খাজিদা আকতার শিল্পী, মলি রানী সরকার, ডা. পূরবী রানী দেবনাথ, শাহীন সুলতানা শান্তা, তাহমিনা সুলতানা, শান্তা আকতার, নাছিমা আকতার ডলি, হোসনে আরা, জাহানারা ইসলাম, সীমা ইসলাম, ছানোয়ারা সুলতানা, সখিনা সিদ্দিক, শারমিন জাহান, রোকেয়া জামান, শিরিন ইসলাম, দিপীকা রানী সমাদ্দার, রোকেয়া বেগম, কাজী আছিয়া জয়নুল, শিরিন বেগম, নাহিদা আলম, হাসিনা দৌলা, নুরজাহান বেগম, মাহফুজা সুলতানা, রোজিনা নাসরিন, ইসরাত জাহান, রাবেয়া বেগম, আজিমুন নাহার, আদিবা আঞ্জুম মিতা, ডেইজি সরোয়ার, খোদেজা নাসরিন, নার্গিস মাহাতাব, নাদিরা পারভীন লাকি, খালিদা আকতার শিল্পী, হুসনা হুদা, সুলতানা রাজিয়া পান্না, রাজিয়া মুস্তফা, শারমিন সুলতানা লিলি, মমতা হেনা লাভলী, খালেদা আকতার রোজী, হামিদা আকতার মিতা, শামীমা সুলতানা ঝর্ণা, গুলশান আরা বেগম, তসলিমা হক, জেসমিন শামীমা নিঝুম, মাহবুবা বেগম, ফেরদৌসী সাঈদ তিথি, নার্গিস আকতার নীলা, সুপ্রিয়া সুলতানা কেয়া, রাশিদা বেগম, শামসুন নাহার, রেবেকা সুলতানা, শাহীনা জেসমিন, শওকত আরা বেগম, আলেয়া বেগম, তানিয়া হক শোভা, রোকসানা পারভীন, সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা, রওশন আরা বেওয়া, আমিনা আকতার, সাবিনা ইয়াসমিন, ফেরদৌসী আলী রুবী, হাজী আলেয়া পারভীন রনজু, নাজমা হোসেন, জান্নাত আরা হেনরী, ইসমত আরা হ্যাপী, রোজিনা নাসরীন, জাকিয়া পারভীন মনি, শামীমা চৌধুরী মিতা, কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, আশরাফুন্নেছা পারুল, আফরোজা মনসুর লিপি, কেশোয়ারা সুলতানা সালমা, ইয়াসমীন সুলতানা পপি, ইসরাত জাহান নাসরীন, আফরোজা হাসান ডেইজী, পারভীন খায়ের, শারমীন জাহান মেরী, সরকার ফারহানা আখতার সুমী, ফরিদা ইয়াসমীন ঝুমা, নিঘাত পারভীন, মর্জিনা পারভীন প্রমুখ।