তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সাম্প্রতিক অসন্তোষের প্রধান কারণ হিসেবে মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করেছে সিপিডি।
শনিবার ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে ‘পোশাকখাতে সাম্প্রতিক মজুরি বিতর্ক: কী শিখলাম?’ শীর্ষক সংলাপে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সিপিডি।
এই ধরনের সমস্যা এড়াতে কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে সংস্থাটি। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এই সুপারিশের প্রশংসা করলেও তা এদেশের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে মত জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা।
এ মাসের শুরুতে তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের পর দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। পরে সরকারের উদ্যোগে কয়েকটি গ্রেডে সংশোধন এনে মজুরি কাঠামো সংস্কার করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর অঞ্চলের ৬১ জন শ্রমিক, কারখানা মালিক ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই অসন্তোষের কারণ খুঁজে বের করার প্রয়াস চালায় সিপিডি; যা শনিবারের অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন সংস্থার গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও মোহাম্মদ আলী।
সিপিডির মতে, নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার আগে ও পরের বিভিন্ন ধাপের কাজে যে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল, তার ফলেই শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে।
মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথার্থ প্রতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি বলে সংস্থাটি মনে করে। তারা বলছে, মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রেডভিত্তিক তারতম্য সৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিকদের মাঝে অঞ্চল ও গ্রেডভেদে মিশ্র উপলব্ধির জন্ম দেয়।
পাশাপাশি তারা বলেছে, নতুন মজুরি সম্পর্কে শ্রমিকদের পূর্ব ধারণা দেওয়ার কোনো উদ্যোগ অধিকাংশ মালিকই নেননি। আবার একেক কারখানায় একেকভাবে মজুরি বাস্তবায়ন ঘটেছে, আবার অনেক কারখানা নতুন কাঠামো অনুসরণ করে মজুরি বাড়ায়নি।
সিপিডির সুপারিশ
>> মজুরির পরিবর্তন বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো।
>> ভবিষ্যতে মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগের সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আরও বেশি মতবিনিময়।
>> নারী শ্রমিকদেরকে তাদের গ্রেড, মজুরি ও অন্যান্য আর্থিক ইস্যুগুলো আরও ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।
>> শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আরও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা।
>> মজুরি আন্দোলনের পর শ্রমিকদেরকে নতুন করে হয়রানি থেকে বিরত থাকা। বিশেষ করে বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজে কাউকে নেতিবাচক তালিকায় পাঠানোর আগে ত্রিপক্ষীয় কমিটি দিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত।
>> মজুরি বৃদ্ধির চাপ কারখানাগুলো কীভাবে সামলাবে সেজন্য ব্রান্ড ও বায়ারদের উচিত যৌথভাবে একটি কৌশল নির্ধারণ করা।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সিপিডির সুপারিশগুলোর প্রশংসা করে বলেন, ভবিষ্যতে এই সুপারিশ একটি ‘গাইডলাইন’ হিসাবে ভূমিকা রাখবে।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টচার্য।
বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, শহিদুল আজিম, মুমীনুর রহমান, শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ, বাবুল আকতার, কাজী রুহুল আমিন, নুরুল ইসলাম।
পোশাক শিল্প মালিক টিপু মুনশি মালিকপক্ষকেও গড়িমসি না করে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “২/১ জন মালিকের জন্য যেন এই সেক্টরের বদনাম না হয়।”
এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মজুরি কাঠামোয় গ্রেডে সংখ্যা কমিয়ে আনার উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “গ্রেডের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। কারণ পোশাকখাতে মজুরি হয় কাজের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে।”
মজুরি বাড়লেও বিশ্ববাজারে দিনে দিনে পোশাকের দাম কমছে দাবি করে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি সরকারি সহায়তা না পেলে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানও একই কথা বলেন। পোশাক শিল্পে সরকার প্রণোদনা বাড়ানোর কথাটিও সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।
পোশাক শিল্প মালিকদের নেতা সিদ্দিকুর বলেন, “করপোরেট ট্যাক্স ও সোর্স ট্যাক্স কমানো হয়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু করপোরেট ট্যাক্স পোশাক খাতের জন্য ১০ শতাংশই ছিল। সেটা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হল, পরে আবার ধাপে ধাপে কমিয়ে ১২ শতাংশ করা হল।”
সিপিডির সুপারিশগুলো বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে মেলে না বলেও দাবি করেন বিজিএমইএ সভাপতি।
তিনি বলেন, “সিপিডি যে প্রস্তাবনা বা তত্ত্ব উপস্থাপন করেছে, তা উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশ এখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রচেষ্টায় আছে। এগুলো আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।”
শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে ভাংচুরে যারা জড়িত ছিল, তা বিষয়ে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তবে অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানি না করতেও বলেন তিনি।
টিপু মুনশি বলেন, “যারা কারখানার ভেতরে ঝামেলা করেছে, তাদেরকে যেন ধরা হয়। কারণ শত শত শ্রমিক যেখানে বিক্ষোভ করেছে, সেখানে দু-চারজন কারখানার কাচে ঢিল ছুড়েছে। তাদেরকে যেন ধরা হয়।”
শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ বলেন, “শ্রমিকরা তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। সেখানে পুলিশ যদি তাদের ওপর আঘাত করে, তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, সেটা সবারই জানার কথা।
“এটা নিয়ে এখন যে শ্রমিক হয়রানি হচ্ছে কিংবা দোষারোপ করা হচ্ছে, সেটা উচিত নয়। মনের ভেতরে ক্ষোভ জমিয়ে রেখে প্রকৃত উৎপাদন সম্ভব নয়। বিক্ষোভের পরিস্থিতি খুব দরদ দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।”
শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভূমিকার রাখার ব্যর্থতার যে কথাটি সিপিডি বলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মন্টু ঘোষ তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “শ্রমিকদেরকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা করতে দিতে হবে।”