ফেব্রুয়ারি মাস এসে গেছে। পৃথিবীর সব দেশেই বিশেষ একটা দিবস সেই একটা দিনের মাঝেই আটকে থাকে। আমরা যেহেতু আবেগের জন্য বিখ্যাত, তাই একটা দিবসকে স্মরণ করে আমরা সারা মাস সেটি পালন করি। ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস, আগস্ট মাস শোকের মাস এবং ফেব্রুয়ারি মাস হচ্ছে ভাষার মাস। আমি অনেককেই বলতে শুনেছি; শুধু আমরাই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। সেটি কিন্তু সত্যি নয়। আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করার কারণে ১৯৬১ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তার মাঝে কমলা নামে ১৬ বছরের একটি মেয়ে ছিল, যে মাত্র আগের দিন তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ করেছিল। সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল সাউথ আফ্রিকায়। ১৯৭৬ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখে স্কুলের প্রায় সাতশ’ ছেলেমেয়েকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের ভাষা আন্দোলনকে থামানোর জন্য। পৃথিবীর অনেক ভাষা আন্দোলনের মাঝে আমাদের ভাষা আন্দোলনটি সারা পৃথিবীতেই বিশেষ একটা গুরুত্ব পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং আমরা যারা বাংলাদেশের মানুষ, তারা জানি; আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটি দিয়েই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজটি বপন করা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার খুঁটিনাটি বিষয় আমাদের মনে পড়ে। একটা সময় ছিল, যখন শুধু কবি-সাহিত্যিক কিংবা ভাষাবিদরা ভাষা নিয়ে কাজ করতেন। এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রটিতে প্রযুক্তিবিদরা বাংলা ভাষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই ভাষার জন্য অবদান রাখার ব্যাপারে আজকাল প্রযুক্তিবিদদের কেউ হেলাফেলা করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, একটা ভাষা পৃথিবীতে কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা পরিমাপ করার জন্য প্রযুক্তিবিদদের কাছে যেতে হয়। একটা ভাষায় তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক মানুষ কথা বলার পরও সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে পরিচিত হতে পারে (উদাহরণ ফরাসি ভাষা); আবার একটা ভাষায় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মানুষ কথা বলার পরও সেই ভাষাটি পৃথিবীতে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে পরিচিত হতে পারে (উদাহরণ বাংলা ভাষা)। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা যখনই বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলেন, তারা ভাষাটিকে কম সমৃদ্ধ (খড়ি জবংড়ঁৎপব) ভাষা হিসেবে বর্ণনা করেন। সে কারণে ভাষাটি এখনও তথ্যপ্রযুক্তিতে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাত্র ভাষা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। এই ভাষার রিসোর্স বাড়ানো কিংবা ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির কিছু প্রয়োজনীয় কলকব্জা তৈরি করতে সরকার থেকে বেশ বড় একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্যোগটি সফল হলে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করার জন্য প্রয়োজনীয় মাল-মসলা কিংবা প্রয়োজনীয় কলকব্জা আমাদের হাতে চলে আসার কথা। ১৬০ কোটি টাকার সেই উদ্যোগটি সত্যি সত্যি হাতে নেওয়া হলে আমরা এর মধ্যে অনেক কিছু পেয়ে যেতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই পাইনি। এমনকি মাঝেমধ্যে সন্দেহ হতে শুরু হয়েছে- সত্যিই কিছু পাব, নাকি অসমাপ্ত প্রজেক্ট হিসেবে টাকাটা ফেরত যাবে, না হয় নষ্ট হবে !
আমরা যারা বাংলা নিয়ে কাজকর্ম করি তারা সবাই জানি, তথ্যপ্রযুক্তি জগতের মহাশক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ‘গুগল’ বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং আমরা হাভাতের মতো তাদের কাজের ওপর নির্ভর করে আছি। শুধু যে নির্ভর করে আছি তা নয়, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাদের সাহায্য করে যাচ্ছি। কিন্তু এই প্রযুক্তিগুলোর জন্য আমরা যদি তাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে থাকি, তাহলে আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি কখনোই দাঁড়াবে না। কাজেই বাংলা ভাষার প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের আরও অনেক বেশি আগ্রহী হতে হবে। আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণার কাজটি আমাদেরই করতে হবে; অন্য কেউ সেটি করে দেবে না- এই বিষয়টা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারব, ততই মঙ্গল।
ভাষা নিয়েই যেহেতু আলোচনা হচ্ছে, আমরা এখানে সবাইকে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে পারি। সবাই কি লক্ষ্য করেছে, আমরা বাংলা কীভাবে লিখব সেটা এখনও ঠিক করতে পারিনি? আমরা যদি বর্ণমালার সব বর্ণ শিখে নিই, তাহলেও কিন্তু আমরা পরিপূর্ণ বাংলা লিখতে বা পড়তে পারি না। পরিপূর্ণ বাংলায় প্রচুর যুক্তাক্ষর আছে এবং বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে সঙ্গে এই যুক্তাক্ষরগুলো শেখা হলেই আমরা বাংলা লিখতে এবং পড়তে পারি। আমরা সবাই এই যুক্তাক্ষরগুলোর সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এই যুক্তাক্ষরগুলো কিন্তু ভিন্নভাবে লেখা হয়। আমরা অনুমান করতে পারি, স্কুলের পাঠ্যবইয়ের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা কোনো একটা সময়ে ধারণা করেছেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রচলিত যুক্তাক্ষরগুলো বেশি ‘কঠিন’। তাদেরকে বিষয়টা আরও সহজভাবে শেখাতে হবে। তাই স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যুক্তাক্ষরগুলো ভেঙে লেখা হয়। যুক্তাক্ষরগুলো যে বর্ণগুলো দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই বর্ণগুলো পাশাপাশি এবং কাছাকাছি লিখে যুক্তাক্ষর তৈরি করা হয়।
যদি এটা সার্বজনীনভাবে গ্রহণ করা হতো, আমাদের কারও কোনো আপত্তি থাকত না। আমরা সবাই মেনে নিতাম। কিন্তু এটি সার্বজনীন নয়। এটি শুধু স্কুলের পাঠ্যবইয়ের জন্য সত্যি। যার অর্থ, আমরা স্কুলের ছেলেমেয়েদের পরিপূর্ণভাবে বাংলা লিখতে কিংবা পড়তে শেখাই না। তারা বিশেষ একটি রূপে বাংলা পড়তে এবং লিখতে শিখে। অন্যভাবে বলা যায়, আমরা যখন স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য পাঠ্যবই তৈরি করি, আমরা তখন ধরেই নিয়েছি- তারা স্কুলের সেই পাঠ্যবইগুলো ছাড়া জীবনেও অন্য কোনো বাংলা বই পড়বে না! এই পাঠ্যবইগুলো ছাড়া অন্য কোনো বাংলা বইয়ে যুক্তাক্ষর এভাবে লেখা হয় না। কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য অসংখ্য ফন্ট রয়েছে এবং আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে আরও অনেক ফন্ট তৈরি হবে। কিন্তু যেহেতু পাঠ্যবইয়ে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে বাংলা লেখা হয়, সেখানে আমরা যে কোনো ফন্ট ব্যবহার করতে পারি না। পাঠ্যবইয়ে একটি এবং শুধু একটি বিশেষ ফন্ট ব্যবহার করতে হয় (আমরা কয়েকজন মিলে ছয়টি পাঠ্যবই লেখার দায়িত্ব নিয়েছিলাম, আমরা মান্ধাতার আমলের পদ্ধতি ব্যবহার না করে আধুনিক ইউনিকোডে লেখার চেষ্টা করেছিলাম বলে আলাদাভাবে সেই বিশেষ একটি ফন্ট তৈরি করিয়ে নিতে হয়েছিল)।
আমি যখন শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনায় কথা বলার সুযোগ পাই, অনেকবার এই বিষয়টিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি! আমার মনে হয়, যারা শিশুদের মনোজগতের বিশেষজ্ঞ এবং যারা শিক্ষার বিষয়টি জানেন, তারা সবাই মিলে আলোচনা করে এই ব্যাপারটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তারা পরিস্কারভাবে আমাদের বলতে পারেন- প্রকৃত যুক্তাক্ষর না শিখিয়ে ভিন্ন এক ধরনের যুক্তাক্ষর ব্যবহার করে বাংলা শিখিয়ে আমরা তাদের সাহায্য করছি, না ক্ষতি করছি (আমি বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, কম বয়সী শিশুরা একসঙ্গে একটি নয় দুটি নয়; পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা শিখে ফেলতে পারে। যে শিশুদের মস্তিস্ক এত জটিল কাজ করতে সক্ষম, তারা সত্যিকারের যুক্তাক্ষর ব্যবহার করে বাংলা পড়তে কিংবা লিখতে পারবে না- আমার সেটা বিশ্বাস হয় না)।
২. আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসটি ভাষার মাস। এর বাইরেও তার আরেকটি পরিচয় আছে, সেটি হচ্ছে- এই মাসটি বইমেলার মাস। এই বইমেলাটি যে শুধু বই বিক্রি করার মেলা, তা কিন্তু নয়। সব মিলিয়ে যত বই কেনাবেচা হয়, তার পরিমাণটুকু খুব বেশি নয় (আজকাল যে কোনো হিসাব হাজার কোটি টাকা দিয়ে করা হয়। কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরি হয়ে গেলেও কেউ বিচলিত হয় না)। বই বেচাকেনার পরিমাণ যতই হোক না কেন, এই মেলাটির গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। এটি আমাদের কালচারের একটা পরিচয়। মেলা থেকে কোনো বই না কিনেও একজন এখানে আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে। লেখকরা সারা বছর আলসেমি করে কাটিয়ে দিয়ে মেলার আগে নাক-মুখ গুঁজে বই লিখতে বসেন। প্রকাশকরা সারাবছর বই প্রকাশ না করে মেলার সময় একসঙ্গে সব বই প্রকাশ করেন। পাঠকরা সারাবছর টাকা জমিয়ে রেখে বইমেলায় এক ধাক্কায় সব বই কিনে ফেলেন (বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ সব বই চোখের আড়াল হয়ে যায়। ইন্টারনেটে বই অর্ডার দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না)।
যতই দিন যাচ্ছে, বইমেলার গুরুত্বটি ততই বেড়ে যাচ্ছে। তার প্রধান কারণ সারা পৃথিবীতেই মানুষজনের বই পড়ার অভ্যাস চলে যাচ্ছে। আমরা যখন বড় হয়েছি, তখন বই ছিল আমাদের প্রধান বিনোদন। আমরা শৈশবে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলেছি, বাসায় এসে ঘাড় গুঁজে গল্পের বই পড়েছি। এখন বিনোদনের কোনো অভাব নেই। একেবারে দুধের শিশুটিও ইউটিউবে কার্টুন দেখতে দেখতে তার দুধের বোতল মুখে দেয়। স্মার্টফোন, নোটপ্যাড, ল্যাপটপ আর টেলিভিশনের স্ট্ক্রিনের বিনোদন যত তীব্রই হোক না কেন; বই পড়ার সঙ্গে তার কোনো তুলনা নেই। বই পড়া হচ্ছে মানুষের মস্তিস্কের একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া, যেটি আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়।
মোটামুটিভাবে পৃথিবীর সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন, নতুন পৃথিবীর সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, কল্পনাশক্তি জ্ঞান থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যদি কল্পনা করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে দামি একটা কম্পিউটারের জটিল একটা এলগরিদমের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্যটা কোথায়? পৃথিবীর প্রত্যেকটা শিশু এই কল্পনা করার ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু যদি তার চর্চা করা না হয়, সেই অমূল্য ক্ষমতাটি একদিন হারিয়ে যায়। মানুষ তখন আর মানুষ থাকে না, তখন শুধু একটা বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ে যায়।
আমি সে জন্য বইমেলাটিকে অনেক গুরুত্ব দিই। আমি আশা করে থাকি, বাবা-মায়েরা তার শিশুসন্তানদের হাত ধরে বইমেলায় আসবেন। শিশুরা বইমেলায় অসংখ্য স্টলে সাজানো হাজার হাজার বই দেখে বুকের মাঝে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করবে। নিজের প্রিয় বইটি কিনে বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখে বাসায় ফিরে যাবে। রাত জেগে সেই বইটি পড়ে কল্পনার জগতে হারিয়ে যাবে। একবার যদি বই পড়ার অভ্যাস করে ফেলে, তাহলে সারা জীবনের জন্য আমরা তাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারব।
সে তখন স্মার্টফোনের জঞ্জালে পা দেবে না; সময় কাটাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে। আজ হোক কাল হোক, এটি ঘটবেই। একটি সময় আসবে, যখন পৃথিবীর মানুষ তার নিজ হাতে তাদের সন্তানদের ইন্টারনেটের কানাগলিতে ঠেলে দেবে না। তাদের হাত ধরে নিয়ে যাবে বইয়ের অপূর্ব বৈচিত্র্যময় কল্পনার জগতে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল