উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে অর্থায়নের নিশ্চয়তা জরুরি বলে মন্তব্য করে এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) আয়োজিত ‘হেলথ ইন ক্রাইসিস- ডব্লিউএইচও কেয়ার্স’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ইবোলা, কলেরা, যক্ষ্মার মত সংক্রামক রোগের মহামারী থেকে বিশ্ব এখনও মুক্ত হতে পারেনি। এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও আধুনিকায়ন ও রূপান্তর প্রয়োজন।
“বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, সঙ্কটের ভয়াবহতা এবং সম্পদ ও সামর্থ্যের অপ্রতুলতার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সুতরাং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের নিশ্চয়তা খুবই জরুরি।“
নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মত কঙ্গো, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের পাশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেভাবে দাঁড়িয়েছে, তার প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা।
এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার জন্য তিনি ডব্লিউএইচওর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, এইচআইভি প্রতিরোধ, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেভাবে সহযোগিতা দিয়ে গেছে, সে কথাও আলোচনায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্যের বিষয়টি সীমান্ত আর নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অঙ্গীকার যেমন জরুরি, তেমনি দরকার নিবিড় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
“এ বিষয়ে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে এখনকার উন্নত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন আমাদের পিছিয়ে পড়া, অসহায়, অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে।”
সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্বেরই অংশ। বিশ্ব সংস্থা হিসেবে ডব্লিউএইচওকেই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে যেতে হবে।”
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষ্যগুলো অর্জনে কার্যকর ও ফলাফলভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য সেবা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে একটি। সুতরাং এর ওপর আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ঘটলেও বহু মানুষ এখনও বিভিন্ন রোগে ভুগছে।
“এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা এখনো সবার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।”
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও শেখ হাসিনা আলোচনায় তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নীতি নির্ধারণ ও অর্থনৈতিক সহায়তাসহ বিভিন্নভাবে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
“আমাদের অব্যহত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এখন স্বল্প খরচে ভালো স্বাস্থ্য সেবার রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৭২ জনে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। নবজাতক শিশু মৃত্যু হার হাজারে ২৪ জনে নামিয়ে আনা গেছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার হাজারে ৩১ জনে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ সব ধরনের টিকার আওতায় এসেছে এবং গড় আয়ু বেড়ে ৭২ দশমিক ৮ বছরে দাঁড়িয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সেবায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ নির্মূলে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে।
সব নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সেবা সহজলভ্য করা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা এবং জরুরি সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে সাড়ে ১৮ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক করে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন হেলথ কেয়ার ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ ও কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে ৩০ রকমের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার কথাও তিনি আলোচনায় বলেন।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার জার্মানিতে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। শুক্রবার দুপুরে তিনি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।
ছয় দিনের এই সফরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে একটি প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতেও তিনি যোগ দেবেন । সফর শেষে ২০ ফেব্রুয়ারি তার ঢাকা ফেরার কথা রয়েছে।