ঢাকায় দুটি জানাজা এবং সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নিজের গ্রামের ঠিকানায় রওনা হলেন নিথর কবি আল মাহমুদ; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই মৌড়াইল গ্রামেই হবে তার শেষ শয্যা।
শ্রদ্ধা জানানোর এই অনুষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে করার ইচ্ছা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন কবির পরিবারের সদস্যরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল সমাধি কিংবা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের অনুমতি চেয়েও তা না পাওয়ায় পৈত্রিক ভূমি মৌড়াইলে দাফন করা হবে বলে কবিপুত্র শরীফ মাহমুদ জানিয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের নেতৃস্থানীয় অন্যতম কবি আল মাহমুদ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভোগার পর শুক্রবার চিরবিদায় নেন। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
গত শতকের ষাটের দশকে সোনালী কাবিন কিংবা কালের কলস তাকে কবি হিসেবে যে উচ্চতায় তুলেছিল পরবর্তী সময় মতাদর্শিক অবস্থান পরিবর্তনে তার কলমে সেরকম লেখা আর আসেনি বলে সাহিত্য সমালোচকদের অনুযোগ। তারপরও আল মাহমুদের সৃষ্টিকর্ম তুলনাহীন বলে তার ভক্তরা মনে করেন।
শুক্রবার মৃত্যুর পর আল মাহমুদের শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানটি অন্য অনেকের মতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কবি পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেও তাদের বিফল হয়ে আসতে হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে গোলাম রব্বানী সাংবাদিকদের কিছু বলতে রাজি হননি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আল মাহমুদের শ্রদ্ধানুষ্ঠান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে করার দাবি তুলেছিল বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছিলেন, তা না হলে বোঝা যাবে, ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তি ‘মুক্তিযোদ্ধা হলেও তার কোনো মূল্য নেই সরকারের কাছে’।
দীর্ঘকাল সাংবাদিকতায় যুক্ত আল মাহমুদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠের সম্পাদক হয়েছিলেন। ওই সময় গ্রেপ্তার হয়ে আল মাহমুদকে কারাগারে যেতে হলেও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আবার তাকে শিল্পকলা একাডেমিতে সহপরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
বাম ঝোঁক থেকে পরে বিপরীতে চলে স্বাধীনতাবিরোধীদের দলের অনুষ্ঠানে আল মাহমুদের অংশগ্রহণ হতাশ করে অনেককে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজার আগে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানটি হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে।
শহীদ মিনারে অনুমতি না মেলার পর বেলা পৌনে ১২টায় বাংলা একাডেমিতে নেওয়া হয় আল মাহমুদের মরদেহ; সেখানে নজরুল মঞ্চে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্যানুরাগী ও ভক্তরা।
সেখানে মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজীর নেতৃত্বে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানায় বাংলা একাডেমি। জীবদ্দশায় একুশে পদকের পাশাপাশি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছিলেন আল মাহমুদ।
আল মাহমুদের রাষ্ট্রীয় সম্মান না পাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জাতীয় কবিতা পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, “জনগণ যখন একজন কবিকে বিবেচনায় নেন, একজন কবিকে কবি হিসেবে মানেন, তখন ধরে নিতে হয়, রাষ্ট্রও তাকে মেনে নিয়েছে। (কিন্তু) রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলে।”
শ্রদ্ধা নিবেদনে অংশ নেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক আনজীর লিটন, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, কবি আবদুল হাই শিকদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শংকর সাঁওজাল, হাসান মাহমুদ, কবি জাকির আবু জাফর, কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ, কবি সালেহীন শিপ্রা, কবি পিয়াস মজিদ, কবি সোহাগ সিদ্দিকী, কবি আবিদ আজম, শিশুসাহিত্যিক মামুন সারওয়ার প্রমুখ।
আল মাহমুদের সৃষ্টি নিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “আমরা যখন বাঙালিয়ানার কথা যদি বলি, তার সঙ্গে যে মঙ্গলময়তা তার কথা যদি বলি, তখন কবি আল মাহমুদকে স্মরণ করতে হবে।”
পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার বাঁকবদলেও আল মাহমুদের অবদানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।
“পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার শৈলী নির্মাণের ক্ষেত্রে কবি আল মাহমুদের ছিল এক নিজস্ব শৈলী।”
হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, “মানবসভ্যতা বা বাংলা জনগোষ্ঠী নিয়ে কবি আল মাহমুদ যা রচনা করে গেছেন, তা মানবজাতির জন্য মূল্যবান আমরা বিবেচনা করি।”
বাংলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কবির কফিন নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে।
সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি জাকির আবু জাফর, চলচ্চিত্রকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, বিএনপি নেতা আহম্মদ আজম খানসহ অনেকে।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলেন, “কবি আল মাহমুদ যে স্বপ্নের সমাজের কথা বলেছেন, তার অনুপস্থিতিতেও সে সমাজ বিদ্যমান থাকুক, আরও উজ্জ্বল হোক, এভাবেই তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।”
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, “তার অবয়ব বাংলা সাহিত্য অনন্তকাল অনুভব করবে।”
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে হয় কবির জানাজা। এর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বায়তুল মোকাররমে। সেখানে বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাজা শেষে মৌড়াইলের উদ্দেশে রওনা হয় কবির কফিন।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই গ্রামটিতে মীর আবদুর রব ও রওশন আরার ঘরে জন্ম আল মাহমুদের। পৈত্রিক নাম ছিল মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ, কিন্তু কবি হিসেবে আল মাহমুদ নামেই পরিচিত হওয়ার পর ঢাকা পড়ে যায় তার পুরো নামটি।
কবির বড় ছেলে শরীফ মাহমুদ জানিয়েছেন, রোববার মৌড়াইল গ্রামে তৃতীয় দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবাকে সমাহিত করা হবে।