সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টায় সরকার ১৫ সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে, যার নেতৃত্বে থাকছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
এছাড়া সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে পরিবহন মলিক-শ্রমিকদের আপত্তির বিষয়ে ‘বাস্তবসম্মত’ সমাধান খুঁজতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
রোববার বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে এই কমিটি গঠন করা হয়।
বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, “পরিবহনে শৃঙ্খলায় আমরা অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকব এমন নয়, কিছুটা সমস্য পরিবহনে আছে। আমার বিশ্বাস, সকলের সহযোগিতায় আমরা পরিবহনের সংকট কাটিয়ে উঠব।”
সপ্তাহখানেক আগে এক অনুষ্ঠানে সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনার বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিগত বছরগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন যতটা হয়েছে, সড়ক ও পরিবহনে শৃঙ্খলা ততটা আসেনি। ফলে দুর্ঘটনা বা যানজট কমছে না।
এ কারণে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভা করে নতুন করে কমিটি সাজানো হবে বলে সেদিনই ইংগিত দিয়েছিলেন মন্ত্রী।
সড়কে দুর্ঘটনা রোধ এবং শৃঙ্খলা ফেরানোর পথ খুঁজতে যে কমিটি করা হয়েছে, সেখানে শাজাহান খানের সঙ্গে আছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ, যিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবং বর্তমান সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন সদস্য হিসেবে আছেন এই কমিটিতে।
ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক ও শ্রমিক সমিতি থেকে দুজন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক, বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে একজন করে প্রতিনিধি এই কমিটিতে থাকবেন।
এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি, ডিআইজি অপারেশনস এবং ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে।
কাদের বলেন, সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে এই কমিটি ১৪ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।
গতবছর জুলাই মাসে দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে পরিবহন খাতের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো নতুন করে সামনে চলে আসে।
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা সড়ক পরিবহন আইন ওই সময়ই শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সংসদে পাস করা হয়। কিন্তু ওই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো বাতিল করার দাবি তোলেন পরিবহন শ্রমিকরা।
তাদের দাবিগুলো হল- সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ, ওয়ে স্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা।
এসব দাবিতে তারা দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট ডাকলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় সারা দেশের মানুষকে। শাজাহান খানসহ পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা সরকারে থাকায় নানা উদ্যোগের পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে।
এখন আইন নিয়ে মালিক- শ্রমিকদের আপত্তির জায়গাগুলো কীভাবে সুরাহা করা যায় তার উপায় খুঁজতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের নেতৃত্বে অন্য কমিটি করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনকে এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস হয়েছে এবং নির্বাচনে আগে স্টেইক হোল্ডারদের পক্ষ থেকে কিছু কমেন্ট অ্যান্ড অভজারভেশন ছিল, কিছু সংশোধনের দাবি দাওয়া ছিল। আইন প্রণয়নের পর আইনটা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় কোনো বিধি বিধান করে, বাস্তবতার সঙ্গে যতটা সংঘতি রাখা যায়.. সেই বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট তিনজন মন্ত্রীকে আমরা দায়িত্ব দিয়েছি।
“তারা আইনটা প্রয়োগ করতে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করবেন। যেহেতু আইনের বিধি এখনও প্রণয়ন হয়নি, তাই স্টেইক হোল্ডারদের দাবির দিক বিবেচনা করে কিছু একটা করা যায় কিনা, সেটা পর্যালোচনা করে দেখবেন।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জানজটের দিক দিয়ে বিশ্বের ২০৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়টি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চান সাংবাদিকরা।
জবাবে তিনি বলেন, “কত রিপোর্ট বের হচ্ছে, টিআইবিরও একটি রিপোর্ট বের হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, এটা বাস্তব চিত্র নয়।”
ওবায়দুল কাদের বলেন, “বাংলাদেশের আজকের উন্নয়ন এবং উচ্চতাকে খাটো করার জন্য, ছোট করার জন্য এবং বাংলাদেশের জন্য যারা ঈর্ষান্নিত, তাদের একটি সিন্ডিকেট এখানে কাজ করছে।”
নবগঠিত দুই কমিটির সদস্যরা ছাড়াও পুলিশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।